দেবী বরণ। দেউলটির সামতাবেড় চট্টোপাধ্যায় বাড়ির ২৫০ বছরের বেশি পুরনো পুজো। দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।
কাগজে ভবানীপুর এলাকার একটি পুজোমণ্ডপের ঢাউস ঢাউস ছবি বেরোচ্ছে। চারদিকে কথাবার্তাও হচ্ছে। কৌতূহল চাপতে না পেরে অষ্টমীর সকালে মণ্ডপটি দেখতে গেলেন মানিকতলার একটি পুজোর উদ্যোক্তারা। দেখেশুনে তাঁরা তো থ! ‘‘আরে আমাদের মণ্ডপের সামনেটাও তো তিন বছর আগে এমনটাই ছিল। শুধু বরফের জায়গায় মেঘ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না?’’ আর এক জন বলে উঠলেন, ‘‘একই জিনিস। শুধু কয়েকটা ফুল গুঁজে দিয়েছে ভিতরে!’’
ঘটনাচক্রে তিন বছরের ব্যবধানে দু’টি মণ্ডপই একই শিল্পীর গড়া।
দক্ষিণ শহরতলির এক পুরস্কার পাওয়া মণ্ডপে গিয়েও একই ধরনের বিস্ময়ের মুখোমুখি ভবানীপুর এলাকারই অন্য একটি পুজোর উদ্যোক্তারা। তাঁদের তিন বছর আগের সুপার-ডুপার হিট মণ্ডপের ছোঁয়া সেখানে। শুরু হয়ে গেল ফিসফাস, ‘‘এ ভাবে নকল করেও পুরস্কার!’’
এ ক্ষেত্রে অবশ্য মণ্ডপও আলাদা, শিল্পীও আলাদা।
ব্যাপারটা শুনে একেবারেই চমকালেন না ঢাকুরিয়ার একটি পুজোর কর্তারা। তাঁদের মণ্ডপের ফাইবার গ্লাসের তৈরি প্রতিমা নাকি পরের বছর বিক্রি হয়ে গিয়েছিল বেহালার এক পুজোয়। এক কর্তার কথায়, ‘‘প্রতিমাটি আমরা শিল্পীর স্টুডিওতে দিয়ে এসেছিলাম। উনি বলেছিলেন, কোনও সংগ্রহশালায় দিয়ে দেবেন। সেটা চলে গিয়েছিল অন্য পুজো কমিটির জিম্মায়।’’ এক প্রতিমা দু’বার বিক্রির খবর ছড়িয়ে পড়ার পরই এক সময় বেশ কিছু পুরস্কার পাওয়া সেই শিল্পীর ‘দাম’ পড়ে যায় পুজোর বাজারে। ‘‘একবার পুজো করা ঠাকুর যে ফের পুজোর জন্য বিক্রি করে দেবেন কেউ, ভাবতে পারিনি!’’ বললেন ঢাকুরিয়ার ওই পুজো কমিটির সভাপতি।
কলকাতার প্রায় সব পুজোই থিমে চলে যাওয়ার পর থেকে নকল করার এই প্রবণতা বেড়ে চলেছে— বলছেন গত দশ বছরে ৩০টি পুজোর পুরস্কার পাওয়া এক প্রবীণ শিল্পী। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘এত ভাবনা শিল্পীদের মাথায় আসবে কী করে? তাই পারমুটেশন-কম্বিনেশন চলছে। এক মণ্ডপে ব্যবহৃত থিম একটু অদলবদল করে পরের বছর অন্য মণ্ডপে চালান করে দেওয়া হচ্ছে।’’ কমবয়সী আর এক শিল্পীর আবার আক্ষেপ, ‘‘আমি তিন বছর আগে একটি অনামী পুজোয় যে আর্ট করেছিলাম, সেটাই এ বার কিছুটা ঘুরিয়ে একটি বড় পুজোয় ব্যবহার করেছেন এক নামী শিল্পী। পুরস্কারও জুটেছে ওই পুজোর ভাগ্যে।’’ কম বয়সের শিল্পী এখন দুধের স্বাদ ঘোলেই মেটাচ্ছেন। দক্ষিণের একটি বড় পুজোয় গত দু’বছর ধরে ব্যবহৃত সামগ্রী দিয়ে এ বার সেজেছে দক্ষিণ কলকাতার একটি পুরনো পুজো। তবে শিল্পী এমন সুচারু ভাবে ওই সব মালপত্র মণ্ডপে ব্যবহার করেছেন যে, গোটাটা নতুন উদ্যোগ বলে মনে হবে।
উপায়ই বা কী? ৭০-৭৫-৬০-৫০-৪০ লাখ বাজেটের পুজো মণ্ডপগুলি নানা উপায়েই বারবার কাজে লাগানো হয়। পঞ্চমী-ষষ্ঠী থেকেই হুগলি, নদিয়ার জগদ্ধাত্রী পুজোর উদ্যোক্তারা কলকাতার মণ্ডপগুলি ঘোরা শুরু করেন। করেন। মণ্ডপ দর্শনে ব্যস্ত থাকেন বারাসত, মধ্যমগ্রামের কালীপুজোর উদ্যোক্তাদের অনেকেও। সাধারণ ভাবে পুজো কমিটিগুলি অপেক্ষা করে অষ্টমীর দুপুর পর্যন্ত।
পুরস্কার পেলে দাম চড়চড় করে ওঠে। রীতিমতো দরদস্তুর করে হয় শিল্পীকে, নয়তো পুজো কমিটিকে অগ্রিম ধরিয়ে দিয়ে যান জগদ্ধাত্রী কিংবা কালীপুজোর উদ্যোক্তারা। সংশ্লিষ্ট শিল্পীর উপরেই দায়িত্ব থাকে মণ্ডপ খুলে নতুন জায়গায় নিয়ে গিয়ে নতুন ভাবে বসানোর। কোথাও বায়না হয় পুজোর কমিটির সঙ্গে, কোথাও শিল্পীর সঙ্গে। মণ্ডপ বেচে পুজো কমিটি নিজেদের ধারদেনা মিটিয়ে পরের বছরের জন্য তৈরি হয়। জগদ্ধাত্রীপুজো, কালীপুজো মিটে গেলে মণ্ডপের বিভিন্ন সামগ্রী শিল্পীরা স্টুডিওতেই রেখে দেন। তার মধ্যে থেকে কিছু শিল্প-সামগ্রী মানুষ কিনে নিয়ে যান ঘর সাজানোর জন্য। কেউ বিয়েবাড়ি সাজানোর জন্য ব্যবহার করেন কিছু জিনিস, বাকিগুলি জমিয়ে রাখা হয় পরের বছরের জন্য। দু-তিনটি মণ্ডপের সামগ্রী দিয়ে তৈরি হয় নতুন কোনও শিল্প। আগের বছরের ‘ফ্লপ’ পুজো ওই সামগ্রী ব্যবহার করেই হয়তো পরের বছর ‘সেরা’ হয়ে ওঠে।
তবে একেবারে নতুন কাজ কিছু হয় না, তা নয়। এ বারের পুজোতেই অন্তত চারটি কাজ থিমের পুজোয় নতুন বাঁক এনেছে। বেলেঘাটা ৩৩ পল্লিতে ট্যাক্সির বিভিন্ন অংশ দিয়ে তৈরি মণ্ডপ ‘নস্টালজিয়া’, শিবমন্দিরে ফ্রেমের আদলে তৈরি ‘চৌখুপি’, ঠাকুরপুকুরের স্টেট ব্যাঙ্ক
পার্ক সর্বজনীনের ‘বাঁক’, সন্তোষপুরের অ্যাভিনিউ সাউথ পল্লিমঙ্গলের
‘পুজো পাগলদের আড্ডা’ এবং কাশীবোস লেনের ‘এসো মুক্ত করো’। সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে ৯৫ পল্লির ‘ইচ্ছেপূরণ’, ৬৬ পল্লির ‘পুরনো কলকাতা’, তেলেঙ্গাবাগানের ‘এদেশের পুজোয় ওদেশের সাজ’, দমদমপার্ক তরুণ দলের ‘সেই তো আমার মা’, ৬৪ পল্লির ‘রূপান্তর’। আরও একটি বাঁক চোখে পড়েছে অনেকেরই। তা হল, প্রতিমা নিয়ে তেমন কোনও পরীক্ষানিরীক্ষা করেননি প্রায় কোনও শিল্পীই। সেই কুমোরটুলি, কালীঘাট কিংবা উল্টোডাঙার স্টুডিও পাড়ারই জয়জয়কার। বাগবাজারের প্রতিমার ধাঁচেই তৈরি হয়েছে বড় বড় অনেক পুজোর প্রতিমার মুখ। এমনিতে কাঠ, টেরাকোটা, চিনেমাটি, ফাইবার গ্লাস কিংবা ধাতুর তৈরি প্রতিমাগুলির ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের বাড়তি মাথাব্যথা। কারণ সংগ্রহশালায় ঠাঁই পাওয়ার আশা রেখেও নিরাশ হওয়ার অভিজ্ঞতা কম নয়। শেষ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিমা গছিয়ে দিতে হয় কোনও বাড়ির ড্রয়িং রুম বা ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায়। কিংবা অনাদরে পড়ে থাকে শিল্পীর স্টুডিওতে। এ বার কলকাতায় কাঠের গুঁড়ি কেটে তৈরি হয়েছে দু’টি প্রতিমা। দু’টি ক্ষেত্রেই উদ্যোক্তাদের আশা, ক্রেতা জুটে যাবে। কিন্তু দশমী পর্যন্ত কোনও প্রস্তাব না আসায় তাঁদের কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy