Advertisement
০৬ মে ২০২৪
Shanti Prasad Sinha

মহাজনি ধাঁচে দলিল বন্ধক দুর্নীতি-চক্রের!

আর্থিক লেনদেনের রাস্তায় যে-সব কর্মপ্রার্থী স্কুলের চাকরি হাসিল করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের তরফে নগদ টাকা দেওয়া, নগদের অভাবে সোনাদানা জমা রাখার কারণ সহজবোধ্য।

Picture of Shanti Prasad Sinha.

শান্তিপ্রসাদ সিংহ। ফাইল চিত্র।

  শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০২৩ ০৭:১৪
Share: Save:

জোতদার-জমিদারদের দিন গিয়েছে। কিন্তু খাজনা দিতে না-পারা গরিবের ভিটেমাটি, জমিজমা বন্ধক রেখে কালক্রমে তা গ্রাস করার যে-কৌশল তাঁরা পুরুষানুক্রমে অনুসরণ করে আসছিলেন, সেটা পরে অস্ত্র হয়ে ওঠে মহাজনদের। চড়া সুদের টাকা ফেরত দিতে না-পারা অসহায় মানুষের শেষ সম্বল ভিটেমাটি আত্মসাতের সেই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্তরাধিকার কি রাজ্যের নিয়োগ দুর্নীতির চক্রীরা বহন করতে চেয়েছিলেন? শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত শান্তিপ্রসাদ সিংহের বন্ধ ফ্ল্যাটে পাওয়া হাজারখানেক সম্পত্তির দলিল দেখে প্রশ্নটা তুলছেন ইডি বা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের তদন্তকারীরা।

আর্থিক লেনদেনের রাস্তায় যে-সব কর্মপ্রার্থী স্কুলের চাকরি হাসিল করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের তরফে নগদ টাকা দেওয়া, নগদের অভাবে সোনাদানা জমা রাখার কারণ সহজবোধ্য। কিন্তু জমি বা অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তির দলিল অভিযুক্তদের হেফাজতে গেল কী ভাবে? ইডি সূত্রের দাবি, কর্মপ্রার্থীরা যেমন নিয়োগপত্র পেতে সর্বস্ব পণ করছিলেন, একই ভাবে সরকারি চাকরির সওদাগরেরা তাঁদের পণ্য অর্থাৎ চাকরি বিক্রির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। দক্ষিণ কলকাতার সন্তোষপুরে শান্তিপ্রসাদের ফ্ল্যাটে পাওয়া তালিকার বেশ কয়েক জন কর্মপ্রার্থীকে ইতিমধ্যেই ডেকে প্রশ্ন করা হয়েছে। ইডি-র দাবি, সেই জিজ্ঞাসাবাদে জানা গিয়েছে, যে-সব অযোগ্য প্রার্থীর আর্থিক অবস্থা ভাল নয়, যাঁদের নগদ টাকা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তাঁদের জমিজমা, গয়না বা অন্যান্য সম্পদ বন্ধক রাখা হয়েছিল। তাই জমা রাখতে হয়েছিল ওই সব দলিল। চাকরি পাওয়ার পরে তাঁদের বেতন থেকে ধাপে ধাপে টাকা শোধ দিয়ে দলিল ও গয়না ফেরতের চুক্তি করা হত। ইডি জানিয়েছে, ওই সব সম্পত্তির দলিল যাচাই করা হচ্ছে।

ইডি সূত্রের দাবি, শান্তিপ্রসাদের ওই ফ্ল্যাটে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষকপদের জন্য দেড় হাজার চাকরিপ্রার্থীর নামের তালিকা পাওয়া গিয়েছে এবং সেই তালিকায় থাকা অধিকাংশই চাকরি পেয়ে গিয়েছেন। আট থেকে ১২ লক্ষ টাকায় এক-একটি চাকরি বিক্রি করা হয়েছিল বলে তদন্তকারীদের দাবি। তাঁরা জানান, সন্তোষপুরের ওই ফ্ল্যাট থেকে প্রচুর দলিলের সঙ্গে সঙ্গে নগদ ৫০ লক্ষ টাকা, দেড় কিলোগ্রাম সোনার গয়নাও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

ইডি সূত্রের দাবি, ফ্ল্যাটে পাওয়া সম্পত্তির নথিপত্রের মধ্যে রয়েছে মূলত পৈতৃক জমি ও বাড়ির দলিল। কয়েক জন কর্মপ্রার্থীর শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তির দলিলও পাওয়া গিয়েছে। যাঁদের সম্পত্তির দলিল নেই বা দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই, তাঁরা সোনার আংটি, দুল, চেন, হার, বালা, বাউটি প্রভৃতি বন্ধক রেখেছিলেন। তদন্তকারীদের দাবি, দুর্নীতিতে যুক্ত ব্যক্তিরা ওই সব গয়নাই আবার বাজারে বন্ধ রেখে সেখান থেকে টাকা তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন।

তদন্তকারীদের অনুমান, কলকাতা হাই কোর্ট বছর দেড়েক আগে নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় একের পর এক নির্দেশ দিতে শুরু করায় কর্মপ্রার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া নগদ টাকা, সোনার গয়না ও সম্পত্তির দলিল ‘যকের ধন’-এর মতো বন্ধ ফ্ল্যাটে লুকিয়ে ফেলেছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত শান্তিপ্রসাদ। তদন্তকারীদের বক্তব্য, আগে শান্তিপ্রসাদের অন্য দু’টি বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে নিয়োগ সংক্রান্ত নানা নথি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি।

নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষকপদে এবং ‘গ্রুপ সি’ বা তৃতীয় শ্রেণির কর্মী-পদে নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় জেল হেফাজতে রয়েছেন শান্তিপ্রসাদ। তাঁর ফ্ল্যাটে পাওয়া তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের একটি বড় অংশকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে শান্তিপ্রসাদকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির মামলাতেও হেফাজতে নেওয়ার জন্য আদালতে আবেদন করা হবে বলে ইডি সূত্রের খবর। তখন ওই চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে শান্তিপ্রসাদকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হতে পারে। এমন আরও টাকা, গয়না ও সম্পত্তির দলিল নেওয়া হয়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে চাইছে ইডি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Shanti Prasad Sinha Recruitment Scam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE