Advertisement
E-Paper

ভোট বাজারে ঝুঁকি নেবে কে, হাতি খতম

নির্বাচন সে বোঝে না, রাজনীতি তো একেবারেই নয়। তবু, নিশ্চুপে ভোটের ‘বলি’ হয়ে গেল সে। তার দোষ, ভোটের মুখে লোকালয়ে ঢুকে অশান্তি ছড়ানো। ক্রমাগত উত্ত্যক্ত করা। পিষে মেরে ফেলা চার গ্রামবাসীকে। সামাল দিতে ঘুমপাড়ানি গুলিতেই তাই শেষ করে দেওয়া হল পূর্ণবয়স্ক হাতিটিকে।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৬ ০৪:০৮
বর্ধমানের ভাতার বাজারে হাতির হানায় মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ চেয়ে সিপিএমের কৃষক সংগঠনের পোস্টার। নিজস্ব চিত্র

বর্ধমানের ভাতার বাজারে হাতির হানায় মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ চেয়ে সিপিএমের কৃষক সংগঠনের পোস্টার। নিজস্ব চিত্র

নির্বাচন সে বোঝে না, রাজনীতি তো একেবারেই নয়। তবু, নিশ্চুপে ভোটের ‘বলি’ হয়ে গেল সে।

তার দোষ, ভোটের মুখে লোকালয়ে ঢুকে অশান্তি ছড়ানো। ক্রমাগত উত্ত্যক্ত করা। পিষে মেরে ফেলা চার গ্রামবাসীকে। সামাল দিতে ঘুমপাড়ানি গুলিতেই তাই শেষ করে দেওয়া হল পূর্ণবয়স্ক হাতিটিকে।

বাঁকুড়ার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে দিন দুই ধরে বর্ধমানের মন্তেশ্বর এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল খান চারেক হাতির দলটি। ঘুমপাড়ানি গুলিতে খুনে হাতিটিকে কাবু করার পরে, অশান্তি এড়াতে বনকর্মীরা তাকে জাগানোর চেষ্টাই করেননি। পুটশুরার মাঠে রবিবার রাতভর পড়ে থেকে ঘুমের মধ্যেই মারা গেল হাতিটি। কেন?

বন দফতরের এক কর্তা জানান, এ ছাড়া তাঁদের আর উপায় ছিল না। গলসির গ্রামে হাতি ঢুকতেই, বর্ধমানের তৃণমূল নেতাদের টেলিফোনে নির্দেশ আসতে শুরু করেছিল— ‘হাতিগুলোকে বাঁকুড়ায় ঠেলে দিন!’ তিনি বলছেন, ‘‘হুলাপার্টি নিয়ে ওদের বাঁকুড়ায় পাঠানোর তোড়জোড়ও শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু এ বার পাল্টা ফোন আসতে শুরু করেছিল বাঁকুড়া থেকে, হাতি যেন ফের এ দিকে না ঢোকে!’’ দুই পড়শি জেলার শাসক দলের নেতাদের ধমকে আর ঝুঁকি নেনি বনকর্তারা। চিরতরেই তাকে ঘুম পাড়ানোর এটাই কারণ বলে দাবি রাজ্যের বন কর্তাদের একাংশের।

গ্রামবাসীদের তাড়ায় দলছুট হয়ে হাতিটির কিশোর সঙ্গী ঢুকেছিল নদিয়ার কালীগঞ্জে। সোমবার বিকেলে তাকেও ঘুমপাড়ানি গুলি করে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ট্রাকে তুলে চালান করা হয় উত্তরবঙ্গের গরুমারায়। এক বনকর্তা বলেন, ‘‘আর ঝুঁকি নেয়? তাকে উত্তরবঙ্গে পাঠিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি আমরা।’’

সরকারি বয়ানে অবশ্য জানানো হয়েছে, বাঁকুড়ায় হাতি রাখার তেমন ব্যবস্থা নেই। গরুমারায় কুনকি হাতির তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ দিতেই স্বল্পবয়সী ওই হাতিটিকে পাঠানো হয়েছে উত্তরবঙ্গে। কিন্তু পূর্ণবয়স্ক হাতিটিকে ঘুমপাড়ানি গুলি করার পর ‘অ্যান্টিডোট ইঞ্জেকশন’ দিয়ে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা হল না কেন? উত্তরটা দিচ্ছেন খোদ বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন— ‘‘এ ছাড়া উপায় ছিল না। ভোটের মুখে চার-চারটে মানুষ মারার পরে আমরা আর ঝুঁকি নিইনি।’’

সেই ‘ঝুঁকি’র আড়ালে যে রয়ে গিয়েছে দুই জেলার শাসক দলের মুহূর্মুহূ চাপ, বনকর্তাদের অনেকেই তা মানছেন। বর্ধমান গ্রামীণ এলাকার তৃণমূলের এক প্রভাবশালী নেতা বলছেন, ‘‘সামনে ভোট, হাতি মানুষ মারবে, গ্রাম তছনছ করবে আর আমাদের তার খেসারত দিতে হবে, তা হয় নাকি!’’

নসিগ্রামের বড়বেলুন ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূলের উপপ্রধান সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় রাখঢাক না রেখে বলেন, ‘‘মেরে হোক, ধরে হোক, হাতি তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে আমরা অবশ্যই প্রশাসনকে চাপ দিয়েছি।” একই সুর মন্তেশ্বরের প্রধান কণিকা রায়ের— ‘‘ভোটের আগে এলাকায় হাতি দাপাবে অথচ বন দফতরের দেখা নেই। প্রশাসনকে চাপ দিয়েছি তাই, রাস্তাও অবরোধ করেছি।’’

বর্ধমানের এক দাপুটে তৃণমূল নেতা ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘হাতিটা চার জনকে মেরেছে, গ্রাম ফুটছে। এই অবস্থায় পশুপ্রেম দেখালে আমরা ভোট পাব কী করে বলুন তো?’’ বাঁকুড়ার এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতাও বলেন, ‘‘এক বছরে এই জেলায় হাতির বলি কত জানেন? ৩২! ভোটের মুখে ওদের তাণ্ডব চললে সোনামুখী, পাত্রসায়র কিংবা গঙ্গাজলঘাঁটিতে আমরা ভোট পাব?’’

বর্ধমান গ্রামীণের তৃণমূল নেতা স্বপন দেবনাথ অবশ্য বলেছেন, ‘‘এ সবই নিছক আপনাদের কল্পনা।’’ আর বাঁকুড়ার জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী মুচকি হেসে সব অভিযোগই উড়িয়ে দিয়েছেন।

বর্ধমানে চলে যাওয়া হাতিদের ফের বাঁকুড়ায় ‘খেদিয়ে’ দেওয়ার ব্যাপারে তাই আপত্তি তুলেছিলেন তিনি। তার জন্য সটান মন্ত্রীকে ফোনও করেছিলেন। সোনামুখীর এক তৃণমূল নেত্রী আবার নির্বিকার গলায় বলছেন, ‘‘এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপত্তাই তো আগে, না কি? সে জন্য হাতিদের প্রায়ই আমরা ঠেলে দিই বর্ধমানে।’’

ভোটের আগে সেই ‘নিরাপত্তা’ সুনিশ্চিত করতে এ বারও রাধামোহনপুরের মাঠ পেরিয়ে গলসির দিকে ‘ঠেলে’ দেওয়া হয়েছিল হাতিগুলিকে।

বর্ধমান না বাঁকুড়া— লক্ষ্মণরেখা বোঝে না সে। বোঝে না সীমানাও। অসময়ে রাজনীতির তপ্ত উঠোনে পা রাখারই মাসুল দিতে হল হয়তো!

elephant election assembly election 2016
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy