Advertisement
১১ মে ২০২৪
তোলা ছেড়ে জমির খোঁজ

মমতার মন্তব্যের পরই অন্য পথে তদন্তে জোর

তদন্তের অভিমুখটাই বদলে গেল! জামুড়িয়ায় দুই তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগে মামলা রুজু হল না। উল্টে কার্যত সেই অভিযোগ যাচাই করতে শ্যাম গোষ্ঠীর এজিএম (এইচআর) সুমিত চক্রবর্তীকে নোটিস দিয়ে ডেকে পাঠাল জামুড়িয়া থানা। আজ, সোমবার বিকেল ৪টে নাগাদ তাঁকে থানায় যেতে বলা হয়েছে।

দেবজিৎ ভট্টাচার্য ও নীলোৎপল রায়চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৪ ০৩:০৫
Share: Save:

তদন্তের অভিমুখটাই বদলে গেল!

জামুড়িয়ায় দুই তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগে মামলা রুজু হল না। উল্টে কার্যত সেই অভিযোগ যাচাই করতে শ্যাম গোষ্ঠীর এজিএম (এইচআর) সুমিত চক্রবর্তীকে নোটিস দিয়ে ডেকে পাঠাল জামুড়িয়া থানা। আজ, সোমবার বিকেল ৪টে নাগাদ তাঁকে থানায় যেতে বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি শ্যাম গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরকারি জমি দখলের তদন্তে সক্রিয় হল পুলিশ-প্রশাসন।

এই পরিস্থিতিতে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, কেন অভিযোগ দায়ের করার চার দিন পরেও নানা যুক্তি দেখিয়ে অভিযুক্ত দুই তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে কোনও আইনি ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ? কেন ওই অভিযোগকে এফআইআর হিসেবেও গণ্য করতে চায়নি তারা? কেন জমি দখলের বিষয়টি প্রশাসনের কাছে রাতারাতি গুরুত্ব পেল? বিরোধীদের অভিযোগ, অভিযুক্ত দুই তৃণমূল নেতা অলোক দাস ও চঞ্চল বন্দ্যোপাধ্যায়কে চটজলদি দল থেকে বহিষ্কার করে আসলে তোলাবাজির বিষয়টিকেই ধামাচাপা দিতে চাইছে শাসক দল। সেই একই উদ্দেশে তদন্তের অভিমুখও ঘুরিয়ে দিতে চাইছে রাজ্য সরকার।

কিন্তু কেন এই অভিমুখ বদল? বিরোধীদের অনেকেই বলছেন, শনিবার বিকেলে কলকাতা বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে জামুড়িয়ায় তোলাবাজির বিষয়টিকে ‘ছোট ঘটনা’ বলে লঘু করার চেষ্টা করেছেন, এবং একই সঙ্গে সরকারি জমি দখলের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন, তাতে পুলিশ-প্রশাসনের কাছে সেই বার্তাই পৌঁছেছে। সে দিন ঠিক কী বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী? বলেছেন: “একটা ছোট ঘটনা। তা-ও কথা কাটাকাটি...। এর সঙ্গে বাস্তব ঘটনার মিল নেই।” বলেছেন, “আমি নিজে এনকোয়ারি করেছি। এই ঘটনার সঙ্গে অন্য ঘটনা জড়িত আছে। রাজ্য সরকারের জমি কেউ গ্র্যাব (দখল) করতে গিয়েছিল। সেই জমি গ্র্যাবের ঘটনা আছে।” প্রশ্ন তুলেছেন, “রাজ্য সরকারের জমি সরকারকে না জিজ্ঞেস করে নেয় কী করে? সেটা নিয়ে এনকোয়ারি করে ডিটেলস জানাব আপনাদের...।”

দৃশ্যত এর পরেই গতি পায় প্রশাসনের দুই প্রক্রিয়া। প্রথমত, সরকারি খাস জমি দখল নিয়ে তদন্ত। দ্বিতীয়ত, অভিযুক্তদের জেরা বা গ্রেফতারের বদলে অভিযোগকারীকেই থানায় ডেকে পাঠানো।

খাস জমি নিয়ে তদন্তের বিষয়ে অবশ্য গত বৃহস্পতিবার থেকেই একটু একটু করে এগোতে শুরু করেছিল বর্ধমান জেলা প্রশাসন। নবান্নের একটি সূত্র বলছে, দুই তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে শ্যাম গোষ্ঠীর অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পরপরই জামুড়িয়া ব্লকের ভূমি রাজস্ব আধিকারিককে (বিএলআরও) ওই সংস্থার কারখানা লাগোয়া জমি মাপজোক করার নির্দেশ দেয় বর্ধমান জেলা প্রশাসন। সেই মতো পরের দিনই ওই এলাকা সরেজমিনে খতিয়ে দেখে জামুড়িয়ার ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক (বিডিও) বুদ্ধদেব পানের কাছে রিপোর্ট জমা দেন বিএলআরও। নবান্ন সূত্র জানাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী দার্জিলিং থেকে কলকাতা ফেরার আগেই এ ব্যাপারে একটা খসড়া রিপোর্টও তৈরি করে ফেলে তারা। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য সেই প্রক্রিয়াকেই জোরদার করেছে বলে মত রাজ্য প্রশাসনের একাংশের। ফলে শনিবার সন্ধ্যায় সেই রিপোর্ট ধরেই জামুড়িয়ায় গিয়ে বিডিও, বিএলআরও, মহকুমা ভূমি রাজস্ব আধিকারিক ও পুলিশকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন বর্ধমানের অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি রাজস্ব) অশোক সাহা। সেখানে শ্যাম গোষ্ঠীর কর্তাদেরও ডাকা হয়। তবে জেলা প্রশাসনের কেউই মুখ খুলতে চাননি।

শনিবার পুলিশের উপস্থিতিতে ওই বৈঠকের পরে সুমিতবাবু বলেন, “আমাদের কাজ চলছে। সাইডিংয়ে পুলিশি পাহারা দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে তদন্তও চলছে। রাজ্য সরকার যে পদক্ষেপ করেছে তাতে আমরা খুশি।”

এই বৈঠকের পরে সুমিতবাবুর প্রতিক্রিয়া শুনে বিরোধীদের একটা বড় অংশই বলছে, যে ভাবে প্রশাসন বিভিন্ন দিক থেকে চাপ তৈরি করছে তাঁদের উপরে, তাতে ‘আমরা খুশি’ বলা ছাড়া উপায় নেই শ্যাম গোষ্ঠীর। কিন্তু তাঁদের খুশি হওয়ার মতো কী পদক্ষেপ করেছে প্রশাসন, সেই প্রশ্নও তুলেছেন বিরোধীরা।

বর্ধমান প্রশাসন সূত্রের খবর, শ্যাম গোষ্ঠীর কারখানা লাগোয়া ধাসনা মৌজায় প্রায় ২৭ একর খাস জমি বহু দিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সেই জমিরই কিছ অংশ দখলের অভিযোগ উঠেছে সংস্থার বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, কীসের ভিত্তিতে এই জমি-তদন্ত শুরু করেছে জেলা প্রশাসন? পুলিশ জানাচ্ছে, যে দুই তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ করেছেন শ্যাম কর্তৃপক্ষ, তাঁদেরই অন্যতম চঞ্চল বন্দ্যোপাধ্যায় গত ৩০ জুন জামুড়িয়া থানায় লিখিত অভিযোগ জানান। সেখানেই ওই সংস্থার বিরুদ্ধে সরকারি জমি দখল ও কারখানার ছাই দিয়ে একটি জোড় (ছোট খাল) বোজানোর অভিযোগ আনেন তিনি। তা হলে কেন এত দিন পুলিশ ওই অভিযোগ ফেলে রেখেছিল? কেনই বা এখন নড়েচড়ে বসল জেলা প্রশাসন? সদুত্তর মেলেনি।

চঞ্চলবাবুর অভিযোগ, “ওই জোড়ের পাশে একটা শ্মশান আছে। আশপাশ গ্রামের বাসিন্দারাও সেখানে আসেন। শ্যাম গোষ্ঠী ছাই দিয়ে ওই জোড় বুজিয়ে দেওয়ায় সৎকারের পরে হাত-পা ধোওয়ারও জল মেলে না।” তাঁর দাবি, কারখানা কর্তৃপক্ষকে বহু বার বলে কোনও সুরাহা না-পেয়েই পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। অন্য এক বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতা অলোক দাসের বক্তব্য, “আমি একাধিক বার গ্রামের লোকজনকে নিয়ে গিয়ে এই সমস্যা জানিয়েছিলাম। কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ আমাদের কথা কানে তোলেনি।”

দুই তৃণমূল নেতার এই অভিযোগ অবশ্য মানতে চাননি শ্যাম কর্তৃপক্ষ। সুমিতবাবু বলেন, “জমি দখলের অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। নিয়মকানুন মেনেই আমরা ওই খাস জমি চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি। দখলের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।”

জেলা প্রশাসনের একাংশও মানছেন, জামুড়িয়ায় গোলমালের পিছনে জমি একমাত্র কারণ নয়। কারখানা কর্তৃপক্ষের উপরে আধিপত্য কায়েম করে স্থানীয় রাজনীতির রাশ নিজেদের হাতে রাখাই ছিল কয়েক জন তৃণমূল নেতার উদ্দেশ্য। কী ভাবে? রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত লোকজন বলছেন, নিজের অনুগামীদের কাজ পাইয়ে দেওয়া কার্যত রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার মধ্যেই পড়ে। আর তা করতে হলে কারখানা কর্তৃপক্ষের উপরে প্রভাব খাটাতেই হবে। শ্যাম গোষ্ঠী যখন যন্ত্র দিয়ে মালপত্র খালাস করা শুরু করে এবং তার ফলে স্থানীয় লোকজন কিছুটা হলেও কর্মহীন হয়ে পড়েন, তখন স্বাভাবিক ভাবেই ঘুরপথে ওই সংস্থার উপরে চাপ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা করে জামুড়িয়ার তৃণমূল নেতাদের একাংশ। তারই জেরে জমি দখলের বিষয়টি প্রকাশ্যে আনা হয়েছে বলেই মত প্রশাসনের একাংশের। আর সরকারি জমি দখলের অভিযোগ যদি সত্যিও হয়, তা হলেও শিল্প সংস্থার কাছ থেকে তোলা চাওয়ার অধিকার জন্মায় কি না, সেই প্রশ্নও থাকছে।

প্রশাসনের দ্বিতীয় প্রক্রিয়া, অর্থাৎ দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করার বদলে শ্যাম-কর্তাদের থানায় তলব নিয়ে আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের পুলিশ বলছে, গত ১৬ জুলাই শ্যাম গোষ্ঠীর তরফে একটি অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয় জামুড়িয়া থানায়। তার ভিত্তিতে একটি জেনারেল ডায়েরি হলেও এমন গুরুতর অভিযোগের ক্ষেত্রে এফআইআর দায়ের করতে যে প্রয়োজনীয় তথ্য থাকার কথা, অভিযোগপত্রে তা নেই। তাই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট ধারায় মামলা দায়ের করা যায়নি। পুলিশের দাবি, জেনারেল ডায়েরির প্রেক্ষিতে ১৭ এবং ১৮ জুলাই পরপর দু’দিন জামুড়িয়া থানার এক জন সাব ইনস্পেক্টর শ্যাম গোষ্ঠীর কারখানায় গেলেও সুমিতবাবুর দেখা পাননি। পরের দিন অবশ্য তাঁর সঙ্গে তদন্তকারী অফিসারের কথা হয়। তারই ভিত্তিতে সমস্ত তথ্য নথিভুক্ত করতে অভিযোগকারীকে ডেকে পাঠানো হয়েছে বলে দাবি পুলিশের।

কিন্তু কেন সব তথ্য জানার পরে তবে এফআইআর হবে? কেনই বা প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে পুলিশ অভিযুক্তদের থানায় ডেকে পাঠাবে না? জামুড়িয়া থানার পুলিশের বক্তব্য, ঘটনার দিনক্ষণ, কত টাকা তোলা চাওয়া হয়েছিল, তার কোনও সাক্ষী থাকলে তাঁর নামধাম এ সব তথ্যও জানাতে হয়। কিন্তু জামুড়িয়া থানার এই বক্তব্য মানতে চাননি রাজ্য পুলিশের একাধিক কর্তা। তাঁরা বলছেন, তোলাবাজেরা কি সাক্ষী রেখে তোলা চায়? না, যে ব্যক্তিকে তোলা চেয়ে হুমকি ফোন করছে দুষ্কৃতীরা, তাঁর হাতের কাছে সাক্ষী থাকে? ওই পুলিশকর্তাদের বক্তব্য, তোলাবাজির অভিযোগ পেয়ে প্রাথমিক ভাবে অভিযুক্তকেই জেরা করা উচিত। তাঁর বক্তব্য তদন্তকারী অফিসারকে সন্তুষ্ট না-করলে সংশয়ের নিরসন হয়ে যায় তখনই। তবে তদন্তের স্বার্থে যদি তদন্তকারী অফিসার মনে করেন অভিযোগকারীকে ডাকা প্রয়োজন, তিনি ডাকতেই পারেন। কিন্তু সেটা আবশ্যিক নয়।

এলাকার ওয়াকিবহাল লোকজন অবশ্য বলছেন, দুর্গাপুর-আসানসোল কমিশনারেটের এই উলট-পুরাণ নতুন কিছু নয়। লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বিজেপি প্রার্থী, বর্তমানে সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় যখন এক তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ জানিয়েছিলেন, তখনও অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ না-করে অভিযোগকারীকেই ডেকে পাঠিয়েছিল রানিগঞ্জ থানা। তখনও পুলিশ তথ্য চাওয়ার কথাই বলেছিল।

আসানসোলের সাংসদ বাবুল এ দিন শ্যাম গোষ্ঠীর ওই কারখানা দেখতে এসেছিলেন। তখন সেখানে পতাকা হাতে অপেক্ষা করছিলেন দলের বহু কর্মী-সমর্থক। কারখানার গেটে পৌঁছে বাবুল বলেন, “আমি এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশে আসিনি। সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় এসেছি। আমি সাংসদ, সকলের প্রতিনিধি। তাই সব পতাকা সরিয়ে ফেলুন। আমার লোকসভা কেন্দ্রে কোনও কারখানা বন্ধ হয়ে যাক, আমি চাই না। আমার পক্ষে যতটা করা সম্ভব, তা করব।” সুমিতবাবুর সঙ্গেও এর পরে কথা বলেন বাবুল। সুমিতবাবু জানান, সাংসদ সমস্যার কথা জানতে চেয়েছিলেন। তাঁকে জানানো হয়েছে, কোনও সমস্যা নেই এখন। দিব্যি কাজ চলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE