Advertisement
E-Paper

‘ট্রাকের বনেটে লাঠি দিয়ে মারতে মারতে এগিয়ে আসছে তারা’

বীরভূমের কোপাই থেকে কলকাতা ফিরব। সঙ্গে ৮৫ বছরের মা। ৮০ বছরের শাশুড়ি। আর স্ত্রী। রবিবার দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরেই বেলা আড়াইটা নাগাদ বেরিয়ে পড়েছি। যাতে আলো থাকতে থাকতেই কলকাতার কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারি।

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৫ ১৮:০৬

বীরভূমের কোপাই থেকে কলকাতা ফিরব। সঙ্গে ৮৫ বছরের মা। ৮০ বছরের শাশুড়ি। আর স্ত্রী। রবিবার দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরেই বেলা আড়াইটা নাগাদ বেরিয়ে পড়েছি। যাতে আলো থাকতে থাকতেই কলকাতার কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারি। নভেম্বর মাস পড়ে গিয়েছে। বিকেল সাড়ে চারটা- পাঁচটার মধ্যেই সূর্য ঢলে পড়তে শুরু করেছ পশ্চিম দিকে।

শ্রীনিকেতন পর্যন্ত হু হু করে চলে এলাম। ভেদিয়ার মোড়ের কাছে এসে চালক স্পিড বাড়িয়ে দিল। কারণ শনিবার কোপাই যাওার পথে এই একই জায়গায় চাঁদার বই হাতে আমাদের পথ আটকেছিল একদল যুবক। আমাদের আগের গাড়ির লোকেদের সঙ্গে বচসা চলছিল ওই যুবকদের। এক জনের হাতে দেখলাম লাঠি। আমরা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় হৈ হৈ করে ছুটে এসেছিল চাঁদা হাতে যুবকেরা। আমরা আর দাঁড়াইনি। স্পিড বাড়িয়ে দ্রুত চলে এসেছি শ্রীনিকেতনের দিকে। ফেরার পথে তাই আশঙ্কা একটা ছিলই। ওই যবকেরা গাড়ি দেখে চিনতে পারবে না তো? নম্বর লিখে রাখেনি তো? স্পিড বাড়িয়ে চালক পেরিয়ে গেল পথটা। দেখলাম, এক ট্রাক চালককে নিয়েই ব্যস্ত তারা। আমাদের দিকে নজর করতে না করতেই আমরা অনেকটা দূর চলে এলাম।

মিনিট কুড়ি গিয়েছি কী যাইনি। দেখলাম রাস্তার দুই দিকে দাঁড়িয়ে আছে লরি। বাঁশ দিয়ে রাস্তা আটকানো। আমরা দাঁড়িয়ে থাকা লরিগুলির পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে দেখলাম। দু’জন যুবক লরিগুলিতে উঠে লাল এবং হালকা নীল রঙর বিল ধরাচ্ছে। পিছন থেকে আসা আরও দুটি ছেলে ড্রাইভারের কেবিনের পা-দানিতে উঠে টাকা নিচ্ছে। একটি সরকারি সংস্থার ভ্যান চালকের সঙ্গে জোর বচসা শুরু হয়ে গেল ওই দুই যুবকের। আশপাশ থেকে লাঠি হাতে ছেলেরা ছুটে এল। সেই সুযোগে আমাদের গাড়ি পার হয়ে গেল চাঁদা সংগ্রহকারীদের। আসার পথে আমরা সকাল সকাল বেরিয়েছিলাম। তাই চাঁদার জুলুমে তেমন পড়তে হয়নি। কিন্তু ফেরার সময়ে পড়ন্ত বিকেলে দফায় দফায় আটকে গেল আমাদের গাড়ি। সৌজন্যে কালী পুজো চাঁদাওয়ালা।

চাঁদা চেয়ে জুলুম, নিগৃহীত হতে হল ম্যাজিস্ট্রেটকেও!
সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন

ভেবেছিলাম গুসকরায় থেমে দুই বৃদ্ধাকে একটি চা-বিস্কুট খাওয়াবো। কিন্তু যে ভাবে রাস্তায় সময় নষ্ট হচ্ছে তাতে সেই পরিকল্পনা বাতিল করতে হল। ঠিক হল শক্তিগড় গিয়ে থামার কথা ভাবা যাবে। কারণ যে ভাবে চাঁদার দলের সংখ্যা বাড়ছে তাতে কতক্ষণে যে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে তে পড়ব সেই চিন্তাই করছিলাম। ভাতারের কাছাকাছি এসে দেখি দুটো ক্লাবের দুটো দল। বেশির ভাগেরই হাতে লাঠি। ট্রাকের বনেটে লাঠি দিয়ে মারতে মারতে এগিয়ে আসছে তারা। ট্রাকের পিছনে আটকে গেল আমাদের গাড়ি। এমন ভাবে রাস্তা ওই যুবকেরা আটকে রেখেছে যে ওভারটেক করে যে বেড়িয়ে যাব তার উপায় নেই। গাড়ি থেকে নেমে পরিস্থিতি যে দেখব তারও উপায় নেই। পিছন থেকে মা-শাশুড়ি নিষেধ করে চলেছেন, ‘না হয় একটু দেরি হবে ফিরতে। গাড়ি থেকে নামা চলবে না।’ গাড়ি থেকে নামিওনি। চাঁদা সংগ্রহকারীরা আমাদের গাড়ির ভিতরে একবার দেখল। তারপরে কি মনে ছেড়েও দিল। দৌড়ে গেল পিছনে এসে থামা একটি ট্রাকের দিকে।

ফের ছাড়া পেয়ে গাড়ির গতি উঠল ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারে। অন্ধকার হতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। সবে চোখটা লেগে এসেছে। গাড়ির গতি কমে এল ফের। দেখলাম ফের লরির লম্বা লাইন। এক ট্রাক চালক বললেন, ‘‘ওরা ছোট গাড়িকে ছেড়ে দিচ্ছে। পাশ দিয়ে এগিয়ে যান। মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছিলাম যে, চাঁদার স্লিপ যদি ধরাতে চায়। দেব না। আমার স্ত্রী পিছন থেকে বির বির করছিলেন, ‘এতখানি রাস্তা পেরিয়ে এলাম। রাস্তায় কোনও পুলিশ নেই।’ সামনে থেকে দেখলাম ছোট গাড়িকেও ধরছে ওরা। গাড়ির কাঁচ বন্ধ। ওদের সামনে এসেই আমার গাড়ির চালক কিছুটা গতি তুলে দিল। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমরা পেড়িয়ে এলাম। কোন কোন পুলিশ অফিসারের নম্বর সেভ করা রয়েছে তা দেখতে সুরু দিয়েছি মোবাইলে। এই ভাবে অন্তত সাত জায়গায় লরির জট কাটিয়ে তালিত স্টেশনের লভেল ক্রসিংয়ের কাছাকাছি যখন এলাম তখন সাড়ে পাঁচটা বেজে গিয়েছে। দেড় ঘণ্টার পথ আসতে সময় নিল পাক্কা তিনঘণ্টা। মনে মনে ভাহছিলাম, এই লেভেল ক্রসিংটা পেরিয়ে গেলেই বর্ধমমান আর মিনিট দশেকের পথ।

কিন্তু ওই পথটাই পেরোতে লাগল পাক্কা ২৫ মিনিট। কেন?

গাড়িটাকে একটা অ্যাম্বুল্যান্সের পিছনে লাগিয়ে ফাঁকফোঁকর দয়ে এগিয়ে এলাম বেশ খানিকটা। মা-শাশুড়ির বারণ অগ্রাহ্য করে এবার কিন্তু নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। লেভেল ক্রসিংয়ের মুখটায় গিয়ে দেখি একটা মাল ভর্তি একটা ট্রাক্টরের একটি চাকা ফেঁসে গিয়েছে। চালক গাড়ির চাকা খোলার চেষ্টা করছেন। লাইনের উপরে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে ট্রাক। লেভেল ক্রসিংয়ের সাইরেন একটানা বেজে চলেছে। অন্যদিক থেকে আসা একটি ট্রাকের সামনে পড়ে গিয়েছে ট্রাক্টরকে ওভারটেক করে আসা অ্যাম্বুল্যান্স। ক্রমাগত হুটার বাজিয়ে চলেছে সেটি। হুটার, সাইরেন, মানুষের হাঁকাহাঁকি সব মিলিয়ে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। কখন এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাব বুঝতে পারছিলাম না। গাড়িতে থাকা দুই বৃদ্ধা ক্রমশ অধৈর্য হয়ে পড়েছেন।

লেভেল ক্রসিংয়ে এমন অবস্থা কিন্তু পুলিশ কোথায়? মিনিট ২০ পড়ে এক পুলিশ কর্মীকে দেখা গেল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে। ট্রাক্টরের গায়ে চর্চ মেরে তিনি কী একটা নম্বর লিখলেন। তারপরে তাঁকে কথা বলতে দেখা গেল এক ব্যক্তির সঙ্গে। পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবী। পুলিশ কর্মীটির সঙ্গে কথা বলেই দেখলাম ওই ব্যক্তি বাইক নিয়ে ভিড়ের মধ্য দিয়ে হাওয়া। চায়ের দোকানী দোকানে বসা একজন কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আরে ওটা ট্রাক্টরের মালিক না?’ একটু দর দাঁড়ানো এক পুলিশ কর্মীর কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, রাস্তায় গাড়ি, লরি থামিয়ে চাঁদা চাইছে। পুলিশ কোথায়? এর পরে তো এই রাস্তা ট্রাক-গাড়ি কিছু যেতেই চাইবে না। ওই পুলিশ কর্মীর দায়সারা জবাব, ‘আমরা তো এখানে। ও সব দেখা আমাদের কাজ নয়।’

গাড়ির কাছে ফিরে আসছি হঠাৎ নাকের ডগায় চাঁদার স্লিপ। অন্ধকারে মুখগুলি চেনা যাচ্ছে না। নির্বিকার ভাবে জানিয়ে দিলাম, ‘‘দেব না। গাড়ি ভাঙতে হয় ভেঙে ফেল। চারপাশে অনেক লোক দেখে চাঁদা সংগ্রহকারীরা দেখলাম হঠাৎ করে উবে গিয়েছে। পাশে দাঁড়ানো এক বাইক আরোহী আশ্বাস দিলেন, ‘অন্ধকার হয়ে গেছে। আর রাস্তায় কেউ আটকাবে না।’ অ্যাম্বুল্যান্সের পিছনে গাড়ি লাগিয়ে মিনিট পঁচিশ পরে পেরিয়ে গেলাম তালিতের লেভেল ক্রসিং। এরপরে অবশ্য আরা কোনও চাঁদা বাহনীকে দেখা গেল না।

বাকি রাস্তা ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালিয়ে চালক যখন বাড়িতে পৌঁছে দিল তখন ঘড়িতে সওয়া আটটা। সাড়ে তিনঘণ্টার রাস্তা পৌঁছতে লাগল পৌনে ছয় ঘণ্টা। তা-ও চা-জলখাবারের জন্য একবারও না থেমে। সৌজন্যে চাঁদা বাহিনী।

ছবি: প্রতীকী।

extortion kali puja subscription debdut ghoshthakur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy