রক্ত সপসপে দেহটা আঁকড়ে ছেলেটি অনর্গল চেঁচিয়ে চলেছিল, ‘‘আছে গো, প্রাণ আছে, ভাইটা বেঁচে রয়েছে গো। তোমরা বুঝতে পারছ না!’’
পুলিশকর্মীরা তাঁকে বোঝাতে গেলে স্বগতোক্তির মতো ছেলেটি বলতে শোনা যায়, ‘‘ভাইটা মরতে পারে না গো....।’’ ডুয়ার্সের দুই প্রান্তিক চা-বাগানে শুক্রবার দুপুর থেকে স্বগতোক্তির মতো এমনই অজস্র বিলাপ। বানারহাটের মোঘলকাটা আর কালচিনির চুয়াপাড়া—শোকের প্রলম্বিত ছায়ায় এ দিন শুধুই স্বজনহারা কান্না।
এ দিন ভোরে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কে ট্রাকের সঙ্গে কন্যাযাত্রী বোঝাই সংঘর্ষে ঘণ্টা কয়েক আগে বিবাহিত দম্পতির সঙ্গেই মারা গিয়েছেন দুই বাগানের কুলি লাইনের তেরো জন। কেউ হারিয়েছেন মা, কেউ সন্তান।
আলিপুরদুয়ার জেলা পরিষদের সভাধিপতি মোহন শর্মার ঘোর কাটছে না, ‘‘সকাল থেকে এলাকার চেহারাটাই বদলে গিয়েছে। একটা-দুটো নয় ১৩টা মানুষ মারা গেল, ভাবতে পারছেন!’’
চুয়াপাড়া বাগানের মানি কিসানের (১৯) সঙ্গে বছর খানেক ধরে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বানারহাটের মোঘলকাটা বাগানের শ্রমিক আকাশ মঙ্গরের (২২)। পরিবার বলতে কেউ নেই আকাশের। ছেলেবেলায় বাবা-মা’কে হারিয়েছেন তিনি। বাগানের এক শ্রমিক বলছেন, ‘‘এ দিন ভোরে এ বার ছেলেটা নিজেই হারিয়ে গেল।’’
বিয়ে করার মতো সামর্থ্য ছিল না বলে মানির পরিবারের কাছে এক বছর সময় চেয়ে নিয়েছিলেন আকাশ। মঙ্গলবার চুয়াপাড়াতে তাঁদের বিয়ে হয়। বৃহস্পতিবার ছিল বৌভাত।
কন্যাযাত্রীরা ছোট একটা গাড়ি ভাড়া করে মোঘলকাটাতে সন্ধ্যাভর নাচ-গানের শেষে ভোর রাতে চুয়াপাড়ার রওনা হয়েছিলেন তাঁরা। তবে মাদারিহাট থানার কাছেই থমকে গিয়েছিল তাঁদের যাত্রা। ২২ জন কন্যাযাত্রীর মধ্যে আকাশ সহ ১১ জনই ঘটনাস্থলে মারা যান। বাকি দু’জন মারা যান হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে। তারপরে ভোরেই দুর্ঘটনার খবর পৌঁছে গিয়েছিল দুই বাগানে। শ্রমিক লাইল থেকে লোকজন ছুটে আসেন মাদারিহাটে।
দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন মানির মা ফুলমণি। তাঁর স্বামী কয়েক বছর ধরে নিখোঁজ। দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার। আকাশের মেসোমশাই রতন ওঁরাও বলেন, ‘‘বারবার বলেছিলাম সকাল হোক, তারপর চা জলখাবার খেয়ে তোমরা বাড়ি ফিরো। কেউ আমার কথা শুনল না।’’ নাগরাকাটার প্রাক্তন বিধায়ক সুখমইত ওঁরাও-এর বাড়ি মোঘলকাটা বাগানে। খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন তিনিও। বলছেন, ‘‘আকাশ আমার আত্মীয়। রাতে অত নাচ-গান হল। ভোর হতে না হতে খবর পেলাম ছেলেটা নেই।’’
আকাশের গলায় তখনও জড়ানো কাগজের মালা। নিথর মুখটা দেখে ডুকরে উঠলেন চুয়াপাড়ার দুই যুবক।
সকালে খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন বাগানের শ্রমিক রিতা ওঁরাও। থানা থেকে সব দেহই তখন চলে গিয়েছে আলিপুরদুয়ারের লাশ-কাটা ঘরে। রাস্তায় বসে মেয়ের নাম ধরে একটানা ডেকে চলেছেন রিতা, ‘‘তুই বেঁচে আছিস তো?’’ মা জানেন না, অ্যম্বুল্যান্সে চড়ে তাঁর মেয়ে তখন লাশকাটা ঘরের দিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy