Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রশ্নের মুখে রাজ্য

স্নাতকোত্তর ডাক্তারিতে অস্ত্রোপচারে রাশ

রাজ্যে এমনিতেই চিকিৎসকের অভাব। অনেক ক্ষেত্রেই সময়মতো অস্ত্রোপচারের জন্য ডাক্তার পাওয়া যায় না। এই অবস্থায় রীতিমতো নির্দেশ জারি করে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে স্নাতকোত্তর প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের সব ধরনের অস্ত্রোপচার করা বন্ধ করে দিল রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর। এই নির্দেশের যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে ডাক্তারির ছাত্রছাত্রীরা তো বটেই, শিক্ষক-চিকিৎসকদের একাংশও তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৫ ০৩:২১
Share: Save:

রাজ্যে এমনিতেই চিকিৎসকের অভাব। অনেক ক্ষেত্রেই সময়মতো অস্ত্রোপচারের জন্য ডাক্তার পাওয়া যায় না। এই অবস্থায় রীতিমতো নির্দেশ জারি করে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে স্নাতকোত্তর প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের সব ধরনের অস্ত্রোপচার করা বন্ধ করে দিল রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর। এই নির্দেশের যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে ডাক্তারির ছাত্রছাত্রীরা তো বটেই, শিক্ষক-চিকিৎসকদের একাংশও তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

স্নাতকোত্তর ডাক্তারি পড়ুয়াদের অস্ত্রোপচারের অধিকারে লাগাম টেনে নির্দেশিকাটি জারি করা হয়েছে গত ২৮ এপ্রিল। তাতে অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে ওই স্তরের তৃতীয় বা চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের উপরেও কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। বলে দেওয়া হয়েছে, এ বার থেকে সিনিয়রদের তত্ত্বাবধান ছাড়া স্নাতকোত্তরের তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়ারা শুধু ছোটখাটো অস্ত্রোপচার করতে পারবেন। কিন্তু কোনও বড় অস্ত্রোপচার করার সময় অপারেশন থিয়েটারে ন্যূনতম অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর স্তরের শিক্ষক-চিকিৎসক এবং সংশ্লিষ্ট পড়ুয়া যে-ইউনিটে কাজ করেন, তার প্রধানের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের অস্ত্রোপচারে সাহায্য করবেন। অর্থাৎ একক দায়িত্বে বড় অস্ত্রোপচার করার অধিকার হারালেন স্নাতকোত্তরের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরাও। এই নিয়ম মানা না-হলে কড়া শাস্তির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে ওই নির্দেশিকায়।

হঠাৎ এমন নির্দেশ কেন?

স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরের খবর, সম্প্রতি কলকাতার একাধিক মেডিক্যাল কলেজে এক মাসের মধ্যে ৪৫ জনেরও বেশি প্রসূতির মৃত্যুর পরে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তদন্ত কমিটি বসিয়ে দেখা যায়, ওই প্রসূতিদের ‘সিজার’ বা অস্ত্রোপচার করেছিলেন মূলত স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্রছাত্রীরা (পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি বা পিজিটি)। তার পরেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এটাই যে কারণ, তার ইঙ্গিত মিলেছে স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যেও। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, প্রথম-দ্বিতীয় বর্ষের স্নাতকোত্তর ছাত্রছাত্রীরা হাতেকলমে অস্ত্রোপচার না-করলে শুধু তৃতীয় বছরে তাঁরা কতটুকু শিখতে পারবেন?

সুশান্তবাবু উত্তর দেন, ‘‘রোগী মেরে শেখাটাও তো কোনও কাজের কথা নয়! আমাদের সময়ে আমরা অপারেশন থিয়েটারের এক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু সিনিয়রদের অস্ত্রোপচার দেখে দেখে শিখেছি। এরাও তা-ই করবে।’’

স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্রছাত্রীদের অস্ত্রোপচারের জেরে কোনও রোগীর মৃত্যু হয়েছে কি?

‘‘এর বেশি আর কিছুই বলা যাবে না। বিপজ্জনক হয়ে যাবে,’’ সতর্ক জবাব স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তার।

রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে আবার গাড়ি চালানো শেখার সঙ্গে বিষয়টির তুলনা টেনে নির্দেশিকা জারির যুক্তি সাজিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘স্নাতকোত্তরের প্রথম-দ্বিতীয় বর্ষের পড়ুয়ারা অস্ত্রোপচার করবেন কেন? যাঁরা সবে গাড়ি চালাতে শিখছেন, তাঁদের কি হাইস্পিডে গাড়ি চালাতে দেওয়া হয়? যদি হাতেকলমে শেখার হয়, তৃতীয় বর্ষেই হবে। বিদগ্ধ ব্যক্তিরা অনেক আলোচনার পরে অস্ত্রোপচার নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্তে এসেছেন।’’

মেডিক্যাল কলেজগুলিতে নয়া নির্দেশিকাটি পৌঁছনো মাত্র শিক্ষক-চিকিৎসক এবং স্নাতকোত্তর ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তাঁরা যে-সব প্রশ্ন তুলেছেন, তার মধ্যে আছে:

• শুধু তৃতীয় বর্ষে হাতেকলমে অস্ত্রোপচারের সুযোগ পেলে কী করে হাত পাকানো সম্ভব?

• বহু চিকিৎসক ১০-১২ বছর কাজের পরে স্নাতকোত্তর স্তরের পাঠ নিতে ঢোকেন। তত দিনে তাঁরা অস্ত্রোপচারে এমনিতেই দক্ষ হয়ে গিয়েছেন। তাঁরা অস্ত্রোপচারের সুযোগ পাবেন না কেন?

• রাজ্যে যেখানে শিক্ষক-চিকিৎসকদের এত আকাল, সেখানে কোনও মেডিক্যালে স্নাতকোত্তর তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়াদের অস্ত্রোপচারে নজরদারি চালানোর জন্য অত জন প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর স্তরের শিক্ষক-চিকিৎসক পাওয়া যাবে কী ভাবে? ওই সব অধ্যাপক তা হলে নিজেদের অস্ত্রোপচার কখন করবেন? কত জন আরএমও (‌রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার)-ই বা নিজেদের কাজ বাদ দিয়ে শুধু পিজিটিদের অস্ত্রোপচারে তত্ত্বাবধান করবেন? রাতের বেলা কী হবে?

• যাঁরা স্নাতকোত্তরের দু’বছরের ডিপ্লোমা কোর্স করবেন, তাঁদের তো তৃতীয় বর্ষ পড়ার সুযোগই নেই। সেই চিকিৎসকেরা কি তা হলে কোনও দিনই একা একা বড় অস্ত্রোপচার করার অনুমতি পাবেন না?

সরাসরি জবাব মিলছে না। স্বাস্থ্যকর্তারা শুধু বলছেন, অভিজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করেই অস্ত্রোপচারের অধিকার নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ওই নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে।

অস্ত্রোপচারে রাশ টানার সঙ্গে সঙ্গে ওই নির্দেশিকায় স্নাতকোত্তর ডাক্তারি পড়ুয়াদের উপরে আরও কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তার মধ্যে আছে:

• এ বার থেকে ইউনিট-হেড এবং সিনিয়র চিকিৎসকদের না-জানিয়ে ওই ছাত্রছাত্রীরা বহির্বিভাগ থেকে কোনও রোগীকে অন্য কোথাও রেফার করতে পারবেন না।

• কোনও পিজিটি ইন্ডোর থেকে রোগীকে ছাড়তে পারবেন না। ইন্ডোরে ডিউটি চলাকালীন ওয়ার্ড ছেড়ে বেরোতে পারবেন না। ভর্তি থাকা রোগীদের যত্ন, ওষুধ দেওয়া, খাওয়াদাওয়া, শয্যার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, এমনকী দাঁত মাজাও ঠিকঠাক হয়েছে কি না, সে-সব দিকে নজর রাখতে হবে পিজিটি-কে।

• প্রেসক্রিপশনে বড় হাতের অক্ষরে জেনেরিক নামে ওষুধ লিখতে হবে এবং নীচে লিখতে হবে নিজের পুরো নাম, ইউনিট, রেজিস্ট্রেশন নম্বর।

কোনও পিজিটি এই নির্দেশ ভাঙলে তিনি হাসপাতালের যে-ইউনিটের অধীন, তার প্রধানও শাস্তি পাবেন। সংশ্লিষ্ট পিজিটি বেশ কয়েক মাসের জন্য কোনও অস্ত্রোপচার করতে পারবেন না। এবং যে-ক’মাস তিনি অস্ত্রোপচার করতে পারবেন না, তাঁর স্নাতকোত্তরের ফল সেই সময়ের জন্য আটকে দেওয়া হবে। অর্থাৎ কেউ ছ’মাস অস্ত্রোপচার করার অধিকার হারালে তাঁর স্নাতকোত্তরের ফল পেতে ছ’মাস দেরি হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE