Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
West Bengal News

ডায়মন্ড হারবারে ‘নিঃশব্দ বিপ্লব’, অভিষেকের পথ কি চওড়া হচ্ছে?

অভিষেক প্রকাশ করলেন সাংসদ হিসেবে তাঁর ‘সাফল্যের’ খতিয়ান, বই আকারে। সেই বইয়ের নাম ‘নিঃশব্দ বিপ্লব’। ২০১৪ সালে সাংসদ হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রীর ভ্রাতুষ্পুত্র অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৮ ১৭:৫৩
Share: Save:

খুব নীরব রাজনীতিক তিনি নন। তাঁর কোনও কোনও মন্তব্যে রাজ্য জুড়ে হইচই পড়ে যায়, তীব্র সমালোচনাও হয়। কিন্তু নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্রের বিষয়ে তাঁর স্ট্র্যাটেজি ঠিক উল্টো। ভোটের প্রস্তুতি হোক বা উন্নয়ন, সবই ‘নীরবে’ বা ‘নিঃশব্দে’ সারতে পছন্দ করেন ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল সাংসদ। কিন্তু সবটা নিরিবিলি থাকছে না আর। রাজ্যের রাজনৈতিক শিবিরে এখন জোর চর্চা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই ‘নিঃশব্দ বিপ্লব’ নিয়ে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ইচ্ছাতেই কি এই বিশেষ বই? প্রশ্ন রয়েছে রাজ্যের রাজনৈতিক শিবিরে।

পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পর্বেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেন্দ্রে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল বিরোধীরা। ডায়মন্ড হারবারে ৯৩ শতাংশেরও বেশি আসনে প্রার্থীই ছিল না বিরোধী দলগুলির। কিন্তু প্রায় পুরোটাই হয়েছিল নীরবে। বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, বাঁকুড়া-সহ বিভিন্ন জেলায় শাসক দলের বিরুদ্ধে নির্বাচনী সন্ত্রাসের অভিযোগ নিয়ে তুমুল হইচই হয়েছিল। কিন্তু সেই সময়েই যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেন্দ্রের অধীনস্থ পঞ্চায়েতগুলিতেও বিরোধীদের মনোনয়ন জমা পড়ছে না, তা গোড়ায় খুব একটা বোঝা যায়নি।

এ বার অভিষেক প্রকাশ করলেন সাংসদ হিসেবে তাঁর ‘সাফল্যের’ খতিয়ান, বই আকারে। সেই বইয়ের নাম ‘নিঃশব্দ বিপ্লব’। ২০১৪ সালে সাংসদ হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রীর ভ্রাতুষ্পুত্র অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কার্যকালের চার বছর অতিবাহিত। এক বছর এখনও বাকি। তবে কাজের খতিয়ান তুলে ধরার জন্য আরও একটা বছর অপেক্ষা করলেন না অভিষেক। সাংসদ হিসেবে প্রথম চার বছরে ডায়মন্ড হারবারের কী কী উন্নতি ঘটালেন তিনি, সেই হিসেবই তুলে ধরলেন বই আকারে।

নিজের নির্বাচনী এলাকাতেই এক সভায় মঙ্গলবার এই বই প্রকাশ করেছেন সাংসদ। মঞ্চে এক ঝাঁক মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়ক ঘিরে ছিলেন অভিষেককে। যাঁরা হাজির ছিলেন বা যাঁরা ছিলেন না, অভিষেকের বই ‘নিঃশব্দ বিপ্লব’ নিয়ে তাঁদের প্রত্যেকের প্রতিক্রিয়াতেই উচ্ছ্বাস। কিন্তু ওইটুকুই। এই উদ্যোগ সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি মন্তব্য করতে কেউই রাজি নন। এমন উদ্যোগ তৃণমূলের অন্য কোনও সাংসদ নিয়েছেন কি না, কোনও নেতা বা সাংসদের সাফল্যের খতিয়ান এ ভাবে বই আকারে আগে কখনও প্রকাশিত হয়েছে কি না, সে সব চর্চায় একেবারেই যেতে চাইছেন না কেউ।

আরও পড়ুন: ‘লিখে নিন, আর কোনও বিজেপি কর্মী খুন হবে না, কী ভাবে রুখতে হয় দেখাব’

বাইয়ের নাম ‘নিঃশব্দ বিপ্লব’ কেন? নেতৃত্বের তরফ থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সংগঠন দেখভাল করেন যাঁরা, সেই নেতাদেরই এক জন বললেন, ‘‘ডায়মন্ড হারবারে গত চার বছরে প্রচুর কাজ হয়েছে। সাংসদ হিসেবে যে ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন, তা সচরাচর দেখা যায় না। গত চার বছরে ডায়মন্ড হারবারের চেহারা কতটা বদলে দিয়েছেন সাংসদ, তা এলাকায় না গেলে বোঝা যাবে না। নিঃশব্দে কাজ করে গিয়েছেন অভিষেক। সেই কারণেই বইয়ের নাম নিঃশব্দ বিপ্লব।’’

রাজনৈতিক শিবিরে চর্চা অবশ্য শুধু নামকরণ নিয়ে নয়। ২০১৯-এর আগে অভিষেকের অস্তিত্বকে আরও উজ্জ্বল করে তোলার জন্য সুচিন্তিত পদক্ষেপ এই বই প্রকাশ, মনে করছেন অনেকেই। তৃণমূলের কোনও স্তরের নেতা এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি নন। তবে দলের কোনও সাংসদ নিজের এলাকার উন্নয়নের খতিয়ান তুলে ধরতে এ রকম ধুমধাম করে বই প্রকাশ করছেন, এমন নজির তৃণমূলে নেই বলে আর এক সাংসদ জানালেন। তিনি বললেন, ‘‘সাংসদ কেমন কাজ করলেন, তার খতিয়ান আমরা আগেও তুলে ধরেছি। ১৯৮৪ সালে দিদি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রথম বার সাংসদ হন। ১৯৮৯ সালে গিয়ে একটা ছাপানো হিসেব প্রকাশ করা হয়েছিল। তুলে ধরা হয়েছিল, পাঁচ বছরে কী কী কাজ করেছিলেন তিনি। তবে সেটা ঠিক বইয়ের আকারে ছিল না।’’

সম্প্রতি পেট্রল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে তৃণমূলের যে আন্দোলন, তাতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।

যে সময়ের কথা ওই সাংসদ বলছেন, তখনও তৃণমূলের জন্ম হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন কংগ্রেস নেত্রী। তৃণমূল গঠিত হওয়ার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া দলের অন্য কোনও সাংসদ বা নেতার কাজ এমন বিশেষ ভাবে তুলে ধরতে এর আগে কেউ উদ্যোগী হয়নি। তা নিয়ে কোনও ক্ষোভ-বিক্ষোভও নেই তৃণমূলে। একাধিক নেতা বরং অকপটে বলছেন— এই দলটায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই সব, তাঁর নামেই ভোট হয়, তাঁর জনপ্রিয়তাতেই দল চলে, সুতরাং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া অন্য কারও কর্মকাণ্ড আলাদা করে তুলে ধরার প্রয়োজন হয়নি।

এ বার কি তা হলে বদলে গেল পরিস্থিতি? না হলে সাংসদ হিসেবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফল্যের খতিয়ান আলাদা করে তুলে ধরার প্রয়োজন পড়ল কেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি বদলায়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বদলে অন্য কোনও মুখকে তুলে ধরতে হবে, এমন প্রয়োজন এখনও পড়েনি। কিন্তু তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বই চাইছেন, ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠুন। সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ইচ্ছাতেই অভিষেকের কাজের খতিয়ান তুলে ধরে বই প্রকাশ করা হচ্ছে বলে বিশ্লেষকদের মত।

এই ব্যাখ্যা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। মমতা নিজেই ধাপে ধাপে ভাইপোর গুরুত্ব বাড়াচ্ছেন দলে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারাভিযানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে ভাবে অংশ নেননি এ বার। কিন্তু অভিষেককে পাঠানো হয়েছিল রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সভা করতে।

পঞ্চায়েতি লড়াইয়ে অভিষেকের নির্বাচনী এলাকায় দলের ফলাফল যাতে প্রশ্নাতীত হয়, তার জন্য অত্যন্ত ‘যত্নবান’ ছিল তৃণমূল। বিরোধীদের দাবি, প্রশাসনও সক্রিয় ছিল সে লক্ষ্যপূরণে, না হলে এত চুপচাপ ৯৩ শতাংশ আসনকে মনোনয়ন পর্বেই বিরোধীহীন করে দেওয়া সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন: ‘পুজোর আবেগে ঘা লাগলে মানুষ ছেড়ে দেবে?’

মহেশতলা বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনেও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যাকেই সামনে এগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গণনার দিন সকাল থেকেই মহেশতলার তৃণমূল প্রার্থী দুলাল দাসকে পাশে নিয়ে বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল অভিষেককে। ব্যবধান বাড়তে বাড়তে জয় যখন প্রায় নিশ্চিত, তখন সমবেত কর্মী-সমর্থকদের দিকে হাত নাড়তে নাড়তে এগিয়ে গিয়ে অভিষেককেই বিজয়োল্লাসের সূচনা করতে দেখা গিয়েছিল। মহেশতলায় দলের জয়ের পর তৃণমূল নেতৃত্বের তরফ থেকে প্রথম প্রতিক্রিয়া অভিষেকই দিয়েছিলেন।

এ বার এল বই প্রকাশ। ‘নিঃশব্দ বিপ্লব’ প্রকাশ করে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু ডায়মন্ড হারবারকে নয়, বরং গোটা রাজ্যকেই জানিয়ে দিলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি কতটা সফল।

সামনের বছরই লোকসভা ভোট। দেশ জুড়ে বিজেপি বিরোধী জোট গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জাতীয় স্তরের রাজনীতিতে তাই তৃণমূলনেত্রী এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে কথা মাথায় রেখেই রাজ্যের রাজনীতিতে ‘যুবরাজের’ ধার-ভার আরও বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। ‘নিঃশব্দ বিপ্লব’ কোনও বিচ্ছিন্ন বা সাধারণ কর্মসূচি নয়। এ আসলে নিঃশব্দে ‘যুবরাজের’ অভিষেকের পথ প্রশস্ত করা। মনে করছে রাজনৈতিক শিবিরের বড় অংশই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE