Advertisement
০৫ মে ২০২৪

আতঙ্কের কাছে হার না মেনে সফল

দুঃস্বপ্নের সেই দিনগুলোতে বই ছিল তার প্রেরণা। বেঁচে থাকার হাতিয়ার। গণধর্ষণের শিকার হয়েও ছাত্রীটি ভেঙে পড়েনি। সমাজে মাথা উঁচু করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সে জীবনের লক্ষ্য করেছিল মাধ্যমিক পরীক্ষাকে। এ দিকে পারিবারিক আর্থিক অনটন বার বার তাকে বাধা দিয়েছে। কিন্তু তবু সে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছে।

এ ভাবেই সিভিক পুলিশের সঙ্গে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল মেয়েটি। —ফাইল চিত্র।

এ ভাবেই সিভিক পুলিশের সঙ্গে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল মেয়েটি। —ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
গাইঘাটা শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৫ ০১:১৪
Share: Save:

দুঃস্বপ্নের সেই দিনগুলোতে বই ছিল তার প্রেরণা। বেঁচে থাকার হাতিয়ার। গণধর্ষণের শিকার হয়েও ছাত্রীটি ভেঙে পড়েনি। সমাজে মাথা উঁচু করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সে জীবনের লক্ষ্য করেছিল মাধ্যমিক পরীক্ষাকে। এ দিকে পারিবারিক আর্থিক অনটন বার বার তাকে বাধা দিয়েছে। কিন্তু তবু সে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছে। শুক্রবার বাড়ির উঠোনে বসে মেয়েটি বলে, ‘‘জীবনে যতই ঘাত প্রতিঘাত আসুক না কেন লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া উচিত। আমার মতো অবস্থায় কেউ যেন লেখাপড়া ছেড়ে না দেয়। লেখাপড়াই মানুষকে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।’’ তাঁর স্বপ্ন এখন লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো।

২০১৪ সালের ১০ জানুয়ারি। দিনটির কথা আজও মনে পড়লে নীরবে চোখ দিয়ে জল পড়ে তার। ঘুমের মধ্যেও সে দিনের ঘটনার আতঙ্ক তাড়া করে তাকে। বছর উনিশের মেয়েটি গাইঘাটার শিমুলপুর এলাকার বাসিন্দা। মেয়েটিকে ওই দিন সন্ধ্যায় বাবা ফোন করে বই কিনে দেওয়ার জন্য বাজারে ডাকেন। বাবার ফোন পেয়ে মেয়েটি ঠাকুরনগর বাজারে যায়। অভিযোগ, বই কিনে বাড়ি ফেরার পথে স্থানীয় দুই যুবক (জিকো কীর্তনীয়া, বলরাম মাতা) রাস্তায় তার মুখ চেপে ধরে তাকে মোটরবাইকে করে নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। সেখানে আগে থেকেই আরও এক যুবক (রাজ গোমস) উপস্থিত ছিল। সেও ওই কাজে যুক্ত হয়। মেয়েটির নগ্ন ছবি মোবাইলে তোলা হয় ও তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। রাতে অভিযুক্তরাই মেয়েটিকে বাড়ির কাছে ফেলে রেখে যায়। পরদিন গাইঘাটা থানায় মেয়েটি অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ তিন যুবককে গ্রেফতার করে। সকলেই জামিন পেয়েছে। এখন বনগাঁ আদালতে মামলাটির শুনানি চলছে। মেয়েটি এ দিন বলে, ‘‘পরীক্ষার সাফল্য আমার লড়াই করার সাহস আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। দোষীদের সাজা না হওয়া পর্যন্ত আমি লড়াই চালিয়ে যাব।’’ ওই ঘটনার পর থেকেই কার্যত গৃহবন্দি হয়েই দিন কাটছে ছাত্রীটির। তার মা বাবা ও ভাইও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হন না। মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চলছে নানা হুমকি। বাড়িতে ওই ঘটনার পর থেকেই রয়েছে সর্ব ক্ষণ পুলিশি পাহারা। বাবা পেশায় ভাগচাষি। দুই ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ বহন করতে হিমসিম খেতে হয়েছে মেয়েটির বাবাকে। অভাবের জন্য গৃহশিক্ষককে ছেড়ে দিতে হয়েছিল মেয়েটিকে। তাতেও দমে যায়নি সে। এ বার মাধ্যমিকে ২৩৬ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে ওই ছাত্রী। ঘটনার পর লেখাপড়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল ছাত্রীটি। মেয়েকে বুঝিয়ে সাহস জুগিয়েছেন তার বাবা। মূলত বাবার ইচ্ছে ও সাহসের উপর ভর করেই মেয়েটি ফের পড়াশোনা শুরু করে। সে স্থানীয় শিমুলপুর আনন্দপাড়া নরহরি বিদ্যাপীঠের ছাত্রী। স্থানীয় রামচন্দ্রপুর পল্লিমঙ্গল বিদ্যাপীঠ স্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষার সিট পড়েছিল। গাইঘাটা থানার ওসি অনুপম চক্রবর্তী মেয়েটির বাড়িতে গাড়ি পাঠিয়ে সঙ্গে পুলিশ দিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়া আসার ব্যবস্থা করেছেন। এ দিন অনুপমবাবু বলেন, ‘‘সামাজিক চাপের মধ্যে থেকেও ওই ছাত্রীর ওই সাফল্য যথেষ্ট কৃতিত্বের।’’

এ দিন সকাল ১১টা নাগাদ বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল উঠোনে বসে রয়েছে মেয়েটি। একটু আগেই পরিচিত একজন ইন্টারনেটে ফল দেখে তাকে খুশির খবর শুনিয়েছেন। আনন্দে তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। বাবার চোখও ছলছল। ছাত্রীটি বলে, ‘‘ওই দিনটি কি সহজে ভোলা যায়। পড়তে বসলেই ঘটনার কথা মনে পড়ত। তাই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। ঘটনার পর থেকে বন্ধুরা বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। মন খুলে কখা বলার মতো মানুষও পাশে ছিল না।’’ গাইঘাটার প্রাক্তন ওসি অরিন্দম মুখোপাধ্যায় মেয়ের পড়ার জন্য নিজে বই খাতা কিনে দিয়েছিলেন বলে জানান মেয়েটির বাবা। মেয়েটি বলে, ‘‘অরিন্দমবাবু আমাকে স্বামী বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণের বই দিয়েছিলেন। ওই সব বই পড়ে আমার খুবই আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।’’ অরিন্দমবাবু এখন অশোকনগর থানার ওসি। এ দিন খবর শুনে বললেন ‘‘সবই ওর কৃতিত্ব।’’

স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অলোক বিশ্বাস বলেন, ‘‘মেয়েটিকে আমরা যথাসম্ভব সাহায্য করেছি। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিল সে। অসম্ভব মনের জোর না থাকলে এমনটা সম্ভব নয়। আমরা সকলেই ওর সাফল্যে গর্বিত।’’ মেয়েটির বাবার কথায় ‘‘ভাল তো লাগছেই। যে ঝড় ওর উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে তাতে ভাবতে পারিনি ও পাশ করতে পারবে।’’

ঘটনার পর অনেক নেতা মন্ত্রী সাংসদ বাড়িতে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের আজ দেখা যায় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE