Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ভোল পাল্টে রমরমিয়ে চলছে সাট্টার কারবার

সময়ের সঙ্গে চেহারা বদলাচ্ছে সাট্টার। ঠেকগুলোতে আগেকার ভিড়, গণ্ডগোল— যা ছিল প্রায় বাধ্যতামূলক, এখন প্রায় চোখেই পড়ে না। সৌজন্যে, মোবাইল ফোন।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৫ ০৩:০১
Share: Save:

সময়ের সঙ্গে চেহারা বদলাচ্ছে সাট্টার। ঠেকগুলোতে আগেকার ভিড়, গণ্ডগোল— যা ছিল প্রায় বাধ্যতামূলক, এখন প্রায় চোখেই পড়ে না। সৌজন্যে, মোবাইল ফোন।

যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, আগে ঠেকে রাখা থাকত সাট্টার বোর্ড। সেখানে হাজির পেন্সিলার। যার কাজ ছিল, ছোট্ট-ছোট্ট কাগজে নম্বর লিখে সাট্টা পরিচালনা করা। তাকে ঘিরে থাকত জুয়াড়িরা। তারা পছন্দসই নম্বর বলত, পেন্সিলার সেই নম্বর চিরকুট কাগজে লিখে দিত। সে জন্য নগদ টাকা নিয়ে নিত। খেলা হয়ে যাওয়ার পরে যারা জিতত, তারা ওই চিরকুট দেখিয়ে নগদে টাকা ফেরত পেত।

এলাকার বাজারের শৌচালয়ের পিছনে বা স্টেশনের সাইডিঙের ঘুপচিতে বসা সেই আসর রীতিমতো মার্কামারা হয়ে থাকত। সেখানে যেতে অস্বস্তিতে পড়ত এলাকায় ‘পরিচিত’ মুখ। আসরে জুয়াড়িদের ভিড়, অবাধে মদ্যপান আর টাকাপয়সা লেনদেন নিয়ে ঝুটঝামেলা ছিল রোজকার ব্যাপার। সেই গোলমাল এত দূর গড়াত, যে স্থানীয় মানুষের আপত্তিতে ছুটে আসতে হত পুলিশকেও। বাধ্য হয়ে ধরপাকড়ও করতে হত।

এখন অবশ্য সাট্টার আসরে আর যেতে হচ্ছে না। এসেছে মোবাইলে সাট্টা পরিষেবা। সাট্টার বোর্ড নিয়ে বসে থাকছে পেন্সিলার। তার মোবাইলে ঘন-ঘন ফোন আসছে। ফোনেই নম্বর ‘বুক’ করছে জুয়াড়ি। বলে দিচ্ছে, ‘‘এই দানে ওই নম্বরের ঘরে আমার নামে এত টাকার টিকিট রেখে দাও।’’ সেই মতো খেলা চলছে।

খেলা শেষে জুয়াড়ির কাছে গিয়ে যত টাকার টিকিট কাটা হয়েছে, তা নিয়ে নিচ্ছে পেন্সিলার। যত টাকার ‘দান মিলেছে’ (যত টাকা সে জিতেছে) তা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এরপর গদিঘরে (সাট্টা নিয়ন্ত্রণ হয় যে মূল অফিস থেকে) গিয়ে সাট্টা-মালিককে সারাদিনের হিসেবনিকেশ বুঝিয়ে দিচ্ছে পেন্সিলার। লাভের টাকা থেকে স্থানীয় ‘দাদা’দের কাছে ‘বখরা’ পৌঁছে যাচ্ছে। ‘বখরা’ নিচ্ছেন কিছু পুলিশকর্মী, এমনটাই অভিযোগ।

পুলিশের সূত্র বলছে, উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত সংলগ্ন কদম্বগাছি এলাকাতেই এমন পেন্সিলারের সংখ্যা প্রায় ৫০। অর্থাৎ, পঞ্চাশটির মতো সাট্টার বোর্ড চলছে ওই এলাকাতেই। বেশিরভাগ সাট্টার ঠেকে এখন গিয়ে দেখা যাবে, বোর্ডের কাছে আগের মতো তেমন ভিড় নেই। ব্যবসা চলছে মোবাইল ফোনে। ২০১২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কদম্বগাছির পূর্ব ইছাপুর গ্রামের বাসিন্দা হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক বিকাশবন্ধু মল্লিক খুন হয়ে যান সাট্টা কারবারিদের হাতে। এরপরে স্থানীয় মানুষ এলাকার সাট্টা ও জুয়ার ঠেক ভেঙে আগুন ধরিয়ে দেন। ‘সাট্টা চলতে দেব না’ স্লোগানে মিছিলও করা হয়। পুলিশি নজরদারিও বাড়ে। এর পরে বেশ কিছু দিন সাট্টার আসর বন্ধ ছিল। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, বছরখানেক হল আবার রমরমিয়ে শুরু হয়েছে সাট্টার আসর। তবে এ বার তা অনেকটাই মোবাইল-নির্ভর।

বারাসত থেকে টাকি রোড ধরে গোলাবাড়ির দিকে যেতে রাস্তার পাশেই পড়বে সাট্টার ঠেকগুলি। কদম্বগাছির ধর্মতলা মোড়, পূর্ব ইছাপুর, হাটখোলা, স্টেশন-বাজার, মিলন সঙ্ঘ ক্লাবের পিছন, গোমার পুকুরপাড়ে দাদপুর রাস্তার পাশেই রমরমিয়ে চলছে সাট্টার ঠেক। কদম্বগাছি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গলির মুখেও রয়েছে গোটা চারেক ঠেক। তা নিয়ে স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবকেরা আপত্তি করেছিলেন। সুরাহা হয়নি। এই সব এলাকায় সাট্টার আসরে দেখা মিলবে শাসন এলাকার ভেড়ির কর্মী থেকে শুরু করে, স্থানীয় দুষ্কৃতী, ভ্যানচালক, দিনমজুরদেরও। বড় খেলোয়াড়েরা অবশ্য মোবাইলে খেলার পরে সারা দিনের হিসেবপত্র পাঠিয়ে দেয় সোজা গদি-ঘরে। এক পেন্সিলারের দাবি, প্রতিদিন বোর্ড পিছু গড়ে লক্ষাধিক টাকার খেলা হয়। তাতে অন্তত ৪০ শতাংশ লাভ থাকে বোর্ডের মালিকের। কদম্বগাছির বামনপাড়ার এক গদিঘর থেকে বেশি সাট্টার বোর্ড নিয়ন্ত্রিত হয় বলে পুলিশ সূত্রেই খবর। কিন্তু মাসোহারা পাওয়ায় এ সব সাট্টার আসর বন্ধ করা বা ধরপাকড় তো দূর, পুলিশ নিয়মিত টহলদারিটুকুও করে না বলে অভিযোগ স্থানীয় মানুষের। অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চোধুরী। তাঁর দাবি, নিয়মিত ভাবেই সাট্টার ঠেকে তল্লাশি চালানো হয়। তবে কদম্বগাছিতে সাট্টার রমরমা প্রসঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘ওখানে বাড়তি নজর দিতে বলা হচ্ছে।’’

পুলিশ সুপারের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করার পরেই পুলিশ কয়েকটি ঠেকে অভিযান চালায়। কয়েকজনকে গ্রেফতারও করে। তবে এলাকাবাসীর একটা বড় অংশের বক্তব্য, ‘‘এ ব্যবস্থা আর ক’দ্দিন। আবার সব যে কে সেই হয়ে যাবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gambling Barasat station hatkhola
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE