Advertisement
০২ মে ২০২৪
রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাচার হচ্ছেন মেয়েরা। কোথায় যাচ্ছেন তাঁরা, পিছনেই বা কোন চক্র?
Woman Trafficking

মেয়েকে ‘বাঘে’ নিয়ে গিয়েছে! ডুকরে উঠলেন মা

representational image

—প্রতীকী ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:৫৭
Share: Save:

না, গত পাঁচ বছরে মারিয়ার কোনও খোঁজ মেলেনি।

কাহিনি ডুয়ার্সের একটি চা বাগানের। স্বামী এবং ছোট ছেলেকে নিয়ে আর পাঁচ জনের মতো বছর পঁচিশের মারিয়ার (নাম পরিবর্তিত) সাদামাটা সংসার। বাগানে আগে ছেলে-মেয়ে মিলে কাজ করতেন। মজুরি কম। মারিয়া পাতা তুলতেন। স্বামীও বাগানের শ্রমিক। কোনও মতে সংসার চলে যাচ্ছিল, অন্যদের মতোই। সেই সময়ে হঠাৎই আলিপুরদুয়ারের কালচিনির এক দালাল যোগাযোগ করে তাঁদের সঙ্গে। মারিয়াকে জানায়, কলকাতায় ভাল কাজ আছে। লেগে থেকে করতে পারলে ভাল টাকা। কী কাজ, কোথায় কাজ— কিছুই বিশদে জানতেন না তাঁরা স্বামী-স্ত্রী। কিন্তু পাঁচ-ছ’বছর আগে বাগানের নামমাত্র মজুরির থেকে যে ঢের বেশি টাকা রোজগার করা যাবে, সেটা তাঁরা ‘বুঝেছিলেন’। বুঝিয়েছিল সেই দালাল। তার হাত ধরেই মারিয়া চলে গেলেন কলকাতায়। তার পর...

মারিয়ার স্বামী বলছিলেন, প্রথম দিকে মাসে-দু’মাসে স্ত্রী আসতেন বাগানে। কিছু টাকাও দিয়েছেন স্বামীর হাতে। তার পরে হঠাৎই যেন এই বিপুল জনসংখ্যার মধ্যে উবে গেলেন মারিয়া। পাঁচ বছর আর কোনও খোঁজ নেই। এই ‘নিখোঁজ’ নিয়ে কোনও অভিযোগও হয়নি থানায়। ফলে সে ভাবে কোনও তদন্ত হয়নি।

ডুয়ার্সে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মেয়েদের নিয়ে কাজ করে, এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রথম খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, পিছনে রয়েছে কালচিনির এক দালাল। সেই সূত্র ধরে আরও কিছু তত্ত্বতালাশ চালায় তারা। শেষ পর্যন্ত তাদের অনুমান, কলকাতা থেকে মারিয়াকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সেখানেই তাঁকে তুলে দেওয়া হয়েছে দেহ ব্যবসা চালানো কোনও চক্রের হাতে।

মারিয়াকে যদি ‘গিলে ফেলে’ মহানগর, তা হলে মুর্শিদাবাদে বরহমপুরের কাছে একটি গ্রামে মেয়েকে ‘খেয়ে ফেলেছিল বাঘ’!

সে জেলায় স্কুলে লম্বা ছুটির পরে ছাত্রীর সংখ্যা কমে যাওয়া কোনও বড় বিষয় নয়। বেশিরভাগেরই ‘বিয়ে’ হয়ে যেত। বিয়ে? মুর্শিদাবাদ সম্পর্কে অভিজ্ঞ প্রশাসনের লোকজনেরা বলেন, কিছু তো নাবালিকা বিয়ে হতই। এখনও হয়। আবার কিছু মেয়ে বিয়ের নামে উধাও হয়ে যেত।

বহরমপুরের কাছে সেই গ্রামেই এমন ঘটনা ঘটেছিল কয়েক বছর আগে। বিয়ে কার সঙ্গে হল, বর কী করে— কিছুই প্রায় জানতেন না মেয়ের বাড়ির লোকজন। এমনই এক কিশোরী যখন রাতারাতি বিয়েরনামে উধাও হয়ে যায়, প্রতিবেশীদের টানা প্রশ্নে শেষে কেঁদে ফেলেন মা। বলেন, ‘‘মেয়েকে আমারবাঘে খেয়েছে!’’

কিন্তু বাঘ তো আসবে সুন্দরবনে। মুর্শিদাবাদে কেন? প্রশাসনের লোকজন চোখ ঠেরে বলে ওঠেন, ‘‘তবেই বুঝে নিন, বাঘটা আসলে কী!’’

সুন্দরবনের বাদাবনেও আসে এমন বাঘ। ঘর থেকে নিয়ে যায় মেয়েদের। সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এমনই একটি রুদ্ধশ্বাস সিরিজ করেছেন পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। তিনি আবার তৃণমূলের বিধায়কও। তাঁর চোখে যে পাচার-কাহিনি ধরা পড়ে, তা কি আর প্রশাসনের চোখে পড়ে না?

পড়ে, বলছিলেন ওই সব এলাকায় কাজ করে আসা এক প্রশাসনিক কর্মী। তাঁর কথায়, পাচার সামলাতে তৎপরতাও বাড়ছে। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে মেয়েকে বালাই বলে ধরে নিলে সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিলে, এমন পাচার আটকানো যাবে কী করে! তিনি জানান, বিয়ের নামে পাচারই সব থেকে বেশি হয়। আরও এক ধরনের পাচার প্রক্রিয়া ইদানীং ‘জনপ্রিয়’। সমাজমাধ্যমে আলাপ এবং তার পরে প্রেম। তার পরে এক দিন দু’জনে মিলে বাড়ি থেকে পলায়ন।

উত্তর ২৪ পরগনার এক প্রশাসনিক কর্তাই জানালেন সম্প্রতি বসিরহাট থানা এলাকার একটি ঘটনা। দশম শ্রেণির ছাত্রীর সঙ্গে সমাজমাধ্যমে পরিচয় হয় এক যুবকের। দু’জনে ঠিক করে, দুর্গাপুজোর আগে দেখা করবে মেয়েটির বাড়ির কাছে। সেই মতো ছেলেটি তার দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আসে। দেখা হওয়ার পরে কথায় কথায় ছেলেটি মেয়েটিকে তুলে নেয় মোটরবাইকে। চলে যায় তেঁতুলিয়ায়। সেখান থেকে অটো ভাড়া করে আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়ার নামে সোজা বনগাঁ বাসস্ট্যান্ডের একটি হোটেল। পরে তদন্তে জানা গিয়েছে, তিন দিন ধরে মেয়েটিকে সেখানে আটকে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করে ওই যুবক। শেষে ওই নাবালিকা কোনও উপায়ে হোটেলের এক কর্মীর ফোন থেকে বাড়িতে যোগাযোগ করে। সেখান থেকে খবর যায় বনগাঁ থানায়। পুলিশ গিয়ে হোটেল থেকে উদ্ধার করে মেয়েটিকে। কিন্তু যুবকের সন্ধান পায়নি কেউ।

গত অক্টোবরের এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে করতে প্রশাসনের ওই কর্তাই উল্লেখ করলেন দিব্যেন্দু পালিতের উপন্যাসের কথা, যার উপরে ভিত্তি করে ‘অন্তর্ধান’ ছবিটি তৈরি করেছিলেন তপন সিনহা। তাঁর কথায়, ‘‘সে-ও ছিল এক সত্যি ঘটনা ভিত্তিক কাহিনি। সেখানেও কিন্তু পাচারের মাথা পর্যন্ত পৌঁছনো যায়নি। এখানেও দেখুন, ছেলেটি নিরুদ্দেশ।’’

সীমান্ত এলাকা থেকে এমন ‘নিরুদ্দেশ’ হওয়া খুব সহজ, বলছিলেন স্থানীয় থানার লোকজনই। ঠিক যেমনটা গত ৯ নভেম্বর দেখা গেল, এই জেলারই গাইঘাটায় বিকাশ সরকারের বাড়িতে এনআইএ হানা দেওয়ার পরে। জানা গেল, বিকাশ নাকি বাংলাদেশের বাসিন্দা। তাঁর স্ত্রী ঝর্নাকেও পাওয়া গেল ওই বাড়িতে। তিনি জানালেন, তাঁদের বাড়ি যশোর। ডাক্তার দেখাতে এসে রয়ে গিয়েছেন, ভিসা ফুরিয়ে গিয়েছে বলে।

এই বিকাশের বিরুদ্ধে অভিযোগ মানব পাচারের।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Woman Trafficking Crime Human Traffcking
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE