Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নীলকুঠি পুনর্নির্মাণে উদ্যোগী রাজ্য

নীলচাষ আর তার ইতিহাস সংরক্ষণে উদ্যোগী হল রাজ্য সরকার। এ কারণে চিহ্ণিত করা হয়েছে উত্তর দিনাজপুর আর বাঁকুড়ার দু’টি পরিত্যক্ত নীলকুঠি। প্রথমটির সংরক্ষণের কাজ অনেকটাই শেষ। দ্বিতীয় প্রকল্পটির কাজ শুরু হবে শীঘ্রই।

পাট পোড়ানোর চুল্লি। — নিজস্ব চিত্র।

পাট পোড়ানোর চুল্লি। — নিজস্ব চিত্র।

অশোক সেনগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৫ ০৩:১৮
Share: Save:

নীলচাষ আর তার ইতিহাস সংরক্ষণে উদ্যোগী হল রাজ্য সরকার। এ কারণে চিহ্ণিত করা হয়েছে উত্তর দিনাজপুর আর বাঁকুড়ার দু’টি পরিত্যক্ত নীলকুঠি। প্রথমটির সংরক্ষণের কাজ অনেকটাই শেষ। দ্বিতীয় প্রকল্পটির কাজ শুরু হবে শীঘ্রই। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি কথা হয়েছে ‘নবান্ন’-র এক বৈঠকে।

অবিভক্ত বাংলায় লুইস বার্নার্ডের হাত ধরে নীলচাষ শুরু হয় ১৭৭৭ নাগাদ। কাপড় রাঙানো এবং ওষুধ তৈরির জন্য এই নীল জাহাজে চাপিয়ে পাঠানো হত বিলেতে। এটা এতটাই লাভজনক ছিল, জমিদারদের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদি লিজ নিয়ে ব্রিটিশরা দাপটে চালিয়ে যাচ্ছিলেন এই চাষ। ‘নীলকর সাহেবদের’ অত্যাচার এতটাই চরমে ওঠে, ১৮৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ নাগাদ শুরু হয় বিদ্রোহ। নীলবোঝাই জাহাজ নাকি ডুবিয়ে দেন ক্ষুব্ধ চাষিরা। ঐতিহাসিক যোগেশচন্দ্র বাগল এটিকে ‘অহিংস আন্দোলন’ হিসাবে চিহ্ণিত করে তুলনা করেন সিপাহি বিদ্রোহের সঙ্গে। দীনবন্ধু মিত্র লিখলেন ‘নীলদর্পণ’। নাট্যকারের নাম রইলো না। ‘কশ্চিৎ পথিকস্য’ নামে একটি ভূমিকা জুড়ে দিলেন তিনি। তারপর মুদ্রিত নাটকের কয়েক কপি নিয়ে চলে এলেন কলকাতায়। এর নাট্যরূপ মঞ্চস্থের জন্য গিরিশ ঘোষ তৈরি করলেন ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। এটি ব্যাপক সাড়া ফেলল জনমানসে। ব্রিটিশ সরকার নীল তদন্ত কমিশন বসাল। কমিশনের রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, যে নীল ইংল্যান্ডে পৌঁছয়, তাতে লেগে থাকে মানুষের রক্ত।

আত্রেয়ী, পুনর্ভবা, মহানন্দা, কুলিক প্রভৃতি নদীর তিরে যে সব নীলকুঠি তৈরি হয়েছিল, সেগুলোর ১৫ আনা নিশ্চিহ্ণ হয়ে গিয়েছে। ব্যতিক্রম রায়গঞ্জ থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দূরে করণদিঘির নীলকুঠি গ্রাম আর বাঁকুড়ার পাত্রসায়রে। রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সূত্রের খবর, উত্তর দিনাজপুরের প্রকল্প সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ করা হয় ১৪ লক্ষ ৪৬ হাজার ২০০ টাকা। আর পাত্রসায়রের জন্য ৩৩ লক্ষ টাকা।

কীভাবে ওখানে তৈরি হত নীলখন্ড? সংরক্ষণের কাজে যুক্ত কর্মীরা বলেন, চৌবাচ্চার জলে নীলগাছ ডুবিয়ে রাখা হত। সেগুলো পচিয়ে গরম করা হত বিশেষ ধরনের উনুনে। জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার হত বাঁশ-কাঠ প্রভৃতি। এই উনুনের নীচে বিশেষ আকারের ধাতব নল দিয়ে পাওয়া যেত তরল নীল। সেই নীল ছোট সাবানের আকারে জমাট আকার দিয়ে বাক্সবন্দি করা হত।

কীভাবে হচ্ছে উত্তর দিনাজপুরের নীলকুঠি সংরক্ষণ? প্রায় দেড়শো বিঘা জমিতে হত নীলচাষ। এই চাষের জমির অধিকাংশই চলে গিয়েছে ব্যক্তি মালিকানায়। সাঁওতাল অধ্যুষিত ওই গ্রাম। এ কথা জানিয়ে রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অতিরিক্ত অধিকর্তা দিবাকর পাল বলেন, ‘‘প্রায় এক বিঘা জমির উপর ছিল মূল নীলকুঠি। পরিত্যক্ত অবস্থায় সেখানে পাওয়া যায় পাট পচানোর আটটি চৌবাচ্চা। চার ফুট উঁচু বর্গাকার ছ’টি চৌবাচ্চার সংরক্ষণ হয়েছে। এর প্রতিটি দিক ২০ ফুট ২ ইঞ্চি। ভগ্নপ্রায় ‘হিট চেম্বার’টি প্রায় সাত ফুট উঁচু। আয়তন প্রায় দেড়শো বর্গফুট।’’ মূল আদল আনতে সমকালীন ইট ও মশলা বানিয়ে প্রকোষ্ঠটির পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয় পঞ্চায়েত জায়গাটি তারকাঁটা দিয়ে ঘিরে রেখেছে।

নীলকরদের অত্যাচার নিয়ে হরিশ মুখার্জি সরব হয়েছিলেন তাঁর ‘হিন্দু প্যাট্রিয়টে’। অকালে মারা যান হরিশবাবু। ‘নীলদর্পণ’-এর ইংরেজি অনুবাদ করলেন মাইকেল মধুসূদন। সেটি প্রকাশ করলেন জেমস লঙ। দেশদ্রোহিতার অভিযোগে লঙের কারাবাস হলো। ছড়াকার লিখলেন:

‘‘নীলবাঁদরে সোনার বাংলা / করলে এবার ছাড়খার।/ অসময়ে হরিশ মোলো। / লং এর হলো কারাগার/ প্রজার প্রাণ বাঁচানো ভার।’’

লঙয়ের বিচারের বর্ণনা দিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়— ‘‘জুরিমন্ডলি গঠিত হয়েছে অপূর্বভাবে, বারোজন ইংরেজ, একজন পর্তুগিজ, একজন আর্মেনিয়ান, আর একজন পার্শী। বাংলার চাষিদের ব্যাপার, বাঙালি মুখপাত্র একজনও নেই। জুরিরা একবাক্যে লঙকে দোষী সাব্যস্ত করলো। শেষ মুহূর্তেও লঙকে বাচাবার জন্য তাঁর পক্ষের উকিলরা পুনর্বিচার দাবি তুললো জোরালো ভাবে। তখন চিফ জাস্টিস বার্নস পিকক বিচারের ভার নিলেন। তাতে হেরফের কিছু হলো না। এমনকি একটু সৌজন্যও তিনি দেখালেন না।....... তিনি রায় দিলেন, লঙের এক মাস কারাদন্ড এবং এক সহস্র মুদ্রা জরিমানা (‘সেই সময়’, পৃ ৩০৭)। জরিমানার সেই টাকা মেটালেন কালীপ্রসন্ন সিংহ।

বাস্তব ও সাহিত্যের এই সব ঝলক করণদিঘিতে কীভাবে পাবেন আগ্রহীরা? পরে ছবি ও লেখায় তুলে ধরার পরিকল্পনা হয়েছে। প্রকল্পের আহ্বায়ক বিনয় মনি এ কথা জানিয়ে বলেন, ‘‘এ ছাড়াও, কীভাবে নীল তৈরি হত, তা বোঝা যাবে এই কারখানায়। এর জন্য তৈরি হবে ১৫ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র।’’ গোটা বিষয় নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জেলা জাদুঘর-কর্তৃপক্ষ, জেলা পরিষদ, পূর্ত দফতরের পদস্থ প্রতিনিধিদের সঙ্গে সবিস্তার কথা বলেছেন জেলাশাসক রণধীর কুমার। জেলাশাসক দফতরের এক পদস্থ অফিসার বলেন, ‘‘সংলগ্ন একটা রাস্তার মানোন্নয়ন নিয়ে কথা হচ্ছে পূর্ত-ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে।’’ স্থানীয় শিক্ষক বৃন্দাবন ঘোষ বলেন, ‘‘ছেলেবেলা থেকে পূর্বপুরুষদের কাছে নীলচাষের গল্প শুনেছি। প্রকল্পটি সংরক্ষণ হলে একটা কাজের কাজ হবে। আমি উদ্যোগী হয়ে ছেলেমেয়েদের দেখাতে নিয়ে যাব।’’

সমস্যা কোথায়? ‘নবান্ন’-র এক আধিকারিক বলেন, ‘‘নীলকুঠিতে সাহেবের বাংলো ছিল একটি টিলার উপর। বাংলোটি একেবারে ভেঙে গিয়েছে। তার ছবি মিলছে না। পেলে সেটির পুননির্মাণ হবে। এটি করা গেলে দুর্গম প্রান্তে প্রায় দু’শ বছর আগের একটা অধ্যায় অন্তর থেকে অনুভব করতে পারবেন দর্শকরা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Government Nilkuthi mahananda bankura river
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE