Advertisement
০৪ মে ২০২৪

কলেজ শিক্ষকদের উপরে রাশ টানতে বিল আনছে রাজ্য

নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা কায়েমের কথা বলে সরকারি অনুদানে চলা কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর এ বার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে রাজ্য সরকার। কলেজগুলির ক্ষেত্রে পরিচালন সমিতির প্রশাসনিক ক্ষমতা খর্ব করে প্রস্তাবিত সেই ‘সংস্কারকে’ আইনি স্বীকৃতি দিতে বিধানসভায় বিল আনার প্রস্তুতিও শুরু করেছে শিক্ষা দফতর।

শঙ্খদীপ দাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৬ ০৯:০৯
Share: Save:

নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা কায়েমের কথা বলে সরকারি অনুদানে চলা কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর এ বার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে রাজ্য সরকার। কলেজগুলির ক্ষেত্রে পরিচালন সমিতির প্রশাসনিক ক্ষমতা খর্ব করে প্রস্তাবিত সেই ‘সংস্কারকে’ আইনি স্বীকৃতি দিতে বিধানসভায় বিল আনার প্রস্তুতিও শুরু করেছে শিক্ষা দফতর।

কী ধরনের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চাইছে সরকার? কেমন সংস্কারের কথাই বা ভাবা হচ্ছে?

শিক্ষা দফতর সূত্রে বলা হচ্ছে, সরকারি অনুদানে চলা বা স্পনসরড কলেজগুলিতে অনিয়মের বড় বিষয়ই হল শিক্ষকদের উপস্থিতি। সরকারি কলেজগুলিতে শিক্ষকদের উপস্থিতি নিয়ে যেটুকু শৃঙ্খলা রয়েছে, অনুদানে চলা বা স্পনসরড কলেজগুলিতে সেটুকুও নেই। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে কলকাতার বাইরে বিভিন্ন জেলা ও মফস্সলের কলেজগুলিতে শিক্ষকদের উপস্থিতি নিয়ে প্রচুর গরমিল রয়েছে। কিন্তু এই অনিয়ম সত্ত্বেও সরাসরি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশাসনিক এক্তিয়ার সরকারের নেই। অথচ ওই শিক্ষকদের বেতন দেয় রাজ্য সরকারই। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, কলেজে ছাত্রদের ৭৫ শতাংশ হাজিরা যখন বাধ্যতামূলক, তখন শিক্ষকদের ব্যাপারেও কেন কড়া হবে না সরকার? শিক্ষকরা নিয়মিত কলেজে না এলে কী ভাবে পঠনপাঠন হবে?

শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, সরকারি অনুদানে চলা বা স্পনসরড কলেজগুলিতে শিক্ষকদের হাজিরা নথিভুক্ত করতে এ বার বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা চালু করার কথা ভাবা হচ্ছে। শিক্ষা দফতরে কর্মী ও অফিসারদের জন্য এই ব্যবস্থা আগেই চালু হয়েছে। কিছু কলেজেও এই ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী চাইছেন সব কলেজে এটা চালু হোক। উপস্থিতি নিয়ে কোনও গরমিল পেলে ব্যবস্থাও নেওয়া হোক শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।

সেই সঙ্গে শিক্ষকদের বদলির এক্তিয়ারও নিজের হাতে আনতে চাইছে রাজ্য। সরকারি কলেজগুলির শিক্ষকদের বদলির অধিকার শিক্ষা দফতরের রয়েছে। কিন্তু যে সব কলেজ সরকারি অনুদানে চলে এবং সংশ্লিষ্ট পরিচালন সমিতি যেখানে প্রশাসনিক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে শিক্ষকদের বদলির এক্তিয়ার তাদের হাতে নেই। শিক্ষা দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন— এই উদ্যোগের নেপথ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার একটা ভাবনা থাকলেও প্রয়োজনের দিকটিই বড়। রাজ্যে নতুন অনেক কলেজ শুরু হয়েছে, পুরনো বহু কলেজেরও সংস্কার-সম্প্রসারণ হয়েছে। ফলে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের বদলির প্রয়োজনীয়তা আছে। তা ছাড়া মানবিক কারণও রয়েছে। উদাহরণ দিয়ে শিক্ষা দফতরের এক আমলা বলেন, শারীরিক সমস্যার কারণে সম্প্রতি এক কলেজ শিক্ষক তাঁর বাড়ির কাছে অন্য কলেজে বদলি চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিচালন সমিতি কিছুতেই তাঁকে ছাড়তে রাজি হল না।

এ ছাড়া, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে সাযুজ্য আনা ও তা সময়োপযোগী করে তোলাটাও শিক্ষা দফতরের লক্ষ্য। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তচিন্তার জায়গা। সেখানে কোনও পাঠ্যক্রম চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তবে শিক্ষামন্ত্রী চান কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অভিন্ন পাঠ্যক্রম চালু হোক। তবে এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদদের পরামর্শ নিয়েই এগোবে সরকার।

কলেজে এ ভাবে রাশ টানার পরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগও সরকারের নজরে। অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের রোগ বহু দিনের। নিয়ম মানলে উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া অবশ্য একান্তই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়। সার্চ কমিটি নাম পাঠাবে, আচার্য তথা রাজ্যপাল আনুষ্ঠানিক ভাবে উপাচার্য নিয়োগ করবেন। কিন্তু এই ব্যবস্থায় অন্তর্ঘাত শুরু হয় অনিল বিশ্বাসের হাতে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাথায় নিজেদের লোক বসানোই ছিল সিপিএমের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদকের পরিকল্পনা। যত দিন না উপাচার্য পদে ‘বিশ্বস্ত লোক’ পাওয়া যাচ্ছে তত দিন অস্থায়ী কাউকে দায়িত্ব দেওয়াটাই ছিল কৌশল। সেই রোগের স্থায়ী নিরাময় চাইছে সরকার।

তবে প্রশ্ন হল, সরকারি অনুদানে চলা কলেজগুলিতে যে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার চেষ্টা কি সফল হবে? সরকারের এই পদক্ষেপ নিয়ে বিতর্ক হবে না? অনেকে বলছেন, দলের অন্দরেই বাধার সম্মুখীন হতে পারেন পার্থবাবু। কারণ অধিকাংশ পরিচালন সমিতির মাথায় এখন শাসক দলের নেতারা। শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, দফতরের আমলারাও এই বিষয়ে সতর্ক করেছেন পার্থবাবুকে। তবে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে পার্থবাবু বলেন, ‘‘আমিও তো চাইছি বিতর্ক হোক। উচ্চশিক্ষায় সংস্কারের জন্য রাজ্য সরকার যে ভাবনাচিন্তা করছে, সে বিষয়ে শিক্ষাবিদরা মতামত জানাক। কারণ, সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য হল পঠনপাঠনের মান বাড়ানো এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রশাসনিক শৃঙ্খলা কায়েম করা।’’ সূত্রের খবর, দফতরের আমলাদের পার্থবাবু বলেছেন, রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না। সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়টি ভাবুন।

তৃণমূল সূত্রের মতে, শিক্ষামন্ত্রীর এই উদ্যোগের নেপথ্যে মুখ্যমন্ত্রীরও সমর্থন রয়েছে। তাঁর প্রথম জমানায় শিক্ষাঙ্গন যে ভাবে বার বার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, মমতা সেটা ভাল চোখে দেখেননি। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনতে চাইছেন তিনি। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর তাঁরই পরামর্শে কলেজগুলির ছাত্র সংসদ নির্বাচন এক বছরের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংঘাত-সংঘর্ষ এড়ানোই এর লক্ষ্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

government college
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE