Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

শপিং মলের ধারণাটা বদলে দিলেন আমূল

শেষমেশ ওঁকে রাজি করাতে পারব কি না, কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। কলকাতায় এসে কিছু দিন এ দিক-ও দিক ঘুরেটুরে উনি আবার বেঁকে বসলেন। সেটা ১৯৯৯ কি ২০০০ সাল! আমাদের অনুরোধে সল্টলেকের সিটি সেন্টার গড়তে এসে কলকাতায় শপিং মলের পত্তন নিয়ে উনি কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন। নিউ মার্কেট পাড়া ও উত্তর কলকাতা মিস্টার কোরিয়ার খুব ভাল লেগেছিল।

হর্ষবর্ধন নেওটিয়া
(কর্ণধার, অম্বুজা-নেওটিয়া গোষ্ঠী) শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৫ ০৩:৪৭
Share: Save:

শেষমেশ ওঁকে রাজি করাতে পারব কি না, কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। কলকাতায় এসে কিছু দিন এ দিক-ও দিক ঘুরেটুরে উনি আবার বেঁকে বসলেন।

সেটা ১৯৯৯ কি ২০০০ সাল! আমাদের অনুরোধে সল্টলেকের সিটি সেন্টার গড়তে এসে কলকাতায় শপিং মলের পত্তন নিয়ে উনি কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন। নিউ মার্কেট পাড়া ও উত্তর কলকাতা মিস্টার কোরিয়ার খুব ভাল লেগেছিল। আর তখনই এই শহরে আপাদমস্তক বড়লোকি একটা শপিং মল গড়ে তুলতে ওঁর ভেতরে ভেতরে এক রকম প্রতিরোধও তৈরি হচ্ছিল।

প্রথমটা আমরাও বুঝতে পারছিলাম না, উনি ঠিক কী চান! বার কয়েক মতবিরোধ হওয়াতে চার্লস বেশ রেগেও যান। সিটি সেন্টার নিয়ে আলোচনা-পর্বেই বার দুয়েক কলকাতা থেকে রেগেমেগে মুম্বই চলে গিয়েছিলেন তিনি। আবার বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওঁকে কলকাতায় ধরে আনা হয়।

চার্লস চাইছিলেন, নিছক শপিং মল না-গড়ে কলকাতার জন্য একটা ‘মার্কেটপ্লেস’ গড়ে তুলতে। ওঁর ভাবনা বলছিল, সেটাই কলকাতার চরিত্রের সঙ্গে বেশি খাপ খাবে। কোনও জায়গার পরিবেশের সঙ্গে বেখাপ্পা কিছু তৈরি করায় চার্লসের কখনওই সায় ছিল না। ওঁর বক্তব্য ছিল, এমন একটা জায়গা চাই যেখানে শুধু বড় ব্র্যান্ডের দোকানই নয়, ছোটখাটো দোকানও কিছু থাকবে। নানা বয়সের লোকজন একটু হাত-পা ছড়িয়ে বসতে পারবে, বেড়াতে পারবে, আড্ডা মারবে।

তখন কলকাতায় তেমন জায়গা কোথায় ? পার্ক-টার্কগুলোর অবস্থাও তো তেমন ভাল ছিল না।

এখন স্বীকার করতে লজ্জা নেই, এমন আইডিয়া শুনে প্রথমটা আমরা খানিক প্রমাদই গুনেছিলাম। ভয় হচ্ছিল, অযথা উল্টোপাল্টা লোকের ভিড় বাড়বে না তো! শেষ পর্যন্ত অবশ্য চার্লসের মতটাই থাকল। বা বলা ভাল, আমাদের ধ্যান-ধারণাটাই উনি আমূল পাল্টে দিলেন।

চার্লস আমাদের বোঝালেন, শপিং মল মানেই শহরের কংক্রিটে আড়াআড়ি গজিয়ে ওঠা কোনও আখাম্বা বহুতল নয়। উনি পরে নিজেও সিটিসেন্টার প্রসঙ্গে লেখেন, ‘বিন্দুতে সিন্ধুকে ধরার মতোই সিটিসেন্টারের মধ্যে গোটা কলকাতার প্রাণটাকে ছুঁতে চেয়েছি। নানা মাপের মানুষজনের আনাগোনা, ছোট-বড় দোকানের সমাহারকে ধরতেই বিচিত্র রং ও প্রাণশক্তির মিশেল।’ সিটিসেন্টারের বিরাট উঠোন বা নিউটাউনের সিটিসেন্টারে কুণ্ডের আদলে সিঁড়িটা বাইরে থেকেই দেখা যায়। স্রেফ শপিং মল হিসেবে না-গড়ে সিটি সেন্টার পরিবার বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে সময় কাটানোর বা আড্ডা দেওয়ার জায়গা হিসেবেই গড়ে উঠেছে। হলদিয়া, দুর্গাপুর, শিলিগুড়ি ও ছত্তিসগঢ়ের রায়পুর নিয়ে মোট ছ’টা সিটিসেন্টার। সর্বত্রই নাগরিক-জীবন নিয়ে চার্লস কোরিয়ার ভাবনাটাই আমাদের পথ দেখিয়েছে। ভাবতে ভাল লাগে, ওঁর মনন আমাদের শহরের রোজনামচার ছন্দে কী ভাবে মিশে গিয়েছে।

২০০০-২০০১ থেকে ২০০৪-এ কাজটা শেষ হওয়া অবধি খুব কাছ থেকে দেখেছি, কাজ নিয়ে কী অসম্ভব খুঁতখুঁতে চার্লস। অনেক সময়েই উনি যা চাইছেন বা ওঁর কল্পনার পরিধি কতটা, তা ঠিকঠাক বুঝতে আমাদের অসুবিধে হয়েছে। তখন তেড়ে বকুনি দিতে কসুর করেননি। বকাবকির পরেই অবশ্য ঠান্ডা। কিন্তু যেটা করতে চান, তাতে একফোঁটা আপস করবেন না।

আমি শুনেছি, এর আগে কলকাতায় অন্য একটা প্রকল্পের কাজও ওঁর করার কথা ছিল। সেটা খানিক দূর এগিয়েও হয়ে ওঠেনি। এর জন্যও সম্ভবত কলকাতায় আমাদের কাজটা করা নিয়ে উনি গোড়ায় নিমরাজি ছিলেন। তখন চার্লসের মেয়ে নন্দিতাও বাবার কাজের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। নন্দিতা ও তাঁর স্বামী রাজীব মেহরোত্রার সঙ্গেও আমাদের হৃদ্যতা গড়ে ওঠে।

সিটি সেন্টার শেষ হওয়ার পরে সম্ভবত একবারই এ শহরে এসেছিলেন চার্লস। কোনও একটা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে। আমি অবশ্য পরেও মুম্বইয়ে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করেছি। মাস কয়েক আগে শেষ যোগাযোগ। আমার মাধ্যমেই ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কলকাতা চ্যাপ্টার্স-এর তরফে একটি অনুষ্ঠানে ওঁকে নেমন্তন্ন করা হয়েছিল। আমায় ফোনে বললেন, আসতে পারবেন না। ওই সময়ে অন্য কাজে বিদেশে থাকবেন। আর কথা হয়নি তার পরে।

কাজের সূত্রে চার্লসের কাছে পাওয়া ভালবাসা এবং বকুনি— দু’টোই আমার কাছে প্রাপ্তি হয়ে থাকবে। নিজের কাজ নিয়ে সিরিয়াস কিন্তু নানা বিষয়ে কৌতূহলী একজন আকর্ষণীয় মানুষ হিসেবে ওঁকে সারা জীবন মনে রাখব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE