কলকাতা কিংবা লাগোয়া উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং হাওড়ায় কত বেআইনি অটো চলে? কেউ বলেন, ১০ হাজার, কেউ ২৫ হাজার। কারও দাবি, তার চেয়েও বেশি। কিন্তু সংখ্যাটা ঠিক কত— তাবড় পরিবহণকর্তা থেকে শুরু করে পুলিশ-প্রশাসনের কেউই উত্তর জানেন না। ওই সব বেআইনি অটোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোরও সদিচ্ছাও নেই প্রশাসনের।
বুধবারই কলকাতা হাইকোর্টে বেআইনি অটো আটকাতে প্রশাসনের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত। ‘ডানলপ বাস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর আবেদনের শুনানিতে এ দিন বিচারপতি দত্ত সরকারি কৌঁসুলি অমলকুমার সেনের উদ্দেশে বলেন, ‘‘আদালতের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেবে না? আদালতের নির্দেশকে কি পুলিশ ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চায়?’’
বিচারপতি দত্তের পর্যবেক্ষণ এক্কেবারে ঠিক বলে মানছেন পরিবহণ কর্তারাও। তাঁদের দাবি, ‘‘কখনও কোনও শাসক দলের নেতারা চান না বলেই বেআইনি অটোর বিরুদ্ধে সার্বিক অভিযান চালানো যায় না।’’
অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে শাসক দলের বাধা কেন? দলীয় তহবিল, লোকবল এবং ভোটের নানা কাজে অটো ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই অটো ইউনিয়নের নেতাদের নানা বেআইনি কার্যকলাপ সহ্য করেন শাসক দলের শীর্ষ নেতারা। সিপিএম আমলে তৈরি হওয়া এই অটোরাজের ট্র্যাডিশন বয়ে নিয়ে চলেছে বর্তমান শাসক দল তৃণমূলও। বর্তমান শাসক দলের শ্রমিক সংগঠনের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘প্রতি রুট থেকে অটো পিছু ইচ্ছেমতো টাকা তোলে ইউনিয়ন। বলা হয়, অটোচালকদের বিপদে-আপদে কাজে লাগবে। কিন্তু সিংহভাগই যায় পার্টি-ফান্ডে। এক-একটি রুটে ওই তহবিলের পরিমাণ লক্ষ লক্ষ টাকা।’’
ওই নেতার আরও বক্তব্য, মিছিল থেকে সভা-সমাবেশ ভরিয়ে তোলার ক্ষেত্রে অটোচালকদের বিশেষ ভূমিকা আছে। একটি রুটে হাজার অটো পিছু চালক-সংখ্যা ২৫০০ ছাড়িয়ে যায়। ওই নেতা বলেন, ‘‘নির্দিষ্ট একটি সময়ে অটো চালান সাতশো-আটশো জন। বাকিদের তখন চাইলে দলের কাজে ব্যবহার করাই যায়। ভোটে ওঁরাই সবচেয়ে কাজের। সব কাজ ওঁদের নখদর্পণে।’’
পরিবহণমন্ত্রী হয়ে মদন মিত্র বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বেআইনি অটোর বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে সরকার। বেআইনি অটোর সংখ্যা নির্ধারণ করতে একাধিক কমিটি হয়েছে। কিন্তু এখনও ওই সব রিপোর্ট দিনের আলো দেখেনি।
পরিবহণমন্ত্রী একাধিক বার ঘোষণা করেছেন, বেআইনি অটো চিহ্নিত করতে কলকাতা শহরের প্রতিটি বৈধ অটোয় ‘হাই সিকিওরিটি নম্বর প্লেট’ লাগানো হবে। এই নির্দেশও বাস্তবায়িত হয়নি।
বেআইনি অটো আটকাতে প্রশাসন যে আদৌ সক্রিয় নয়, তার প্রমাণ মিলেছে এ দিন হাইকোর্টের ওই মামলার শুনানিতেও। গত ৬ অগস্ট মামলাটি প্রথম বিচারপতি দত্তের এজলাসে ওঠার পরে বরাহনগর থানার ওসি-র কাছে তিনি জানতে চান, বেআইনি ভাবে ওই এলাকায় অটো চলে কি না। তার বিরুদ্ধে পুলিশ কী ব্যবস্থা নিয়েছে? এ দিন ফের বিচারপতি দত্তের এজলাসে ওঠে মামলাটি। সরকারি কৌঁসুলি বরাহনগর থানার ওসি-র রিপোর্টটি আদালতে দাখিল করেন। পুলিশ সূত্রের খবর, রিপোর্টে লেখা ছিল, আদালতের নির্দেশ পেয়ে বরাহনগর বাজার এলাকায় কয়েক দিন আগে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের পুলিশ বেআইনি অটোর বিরুদ্ধে অভিযানে নামে। সাত-আট জন চালকের লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত হয়।
রিপোর্ট পড়ে বিচারপতি দত্ত সরকারি কৌঁসুলির কাছে জানতে চান, অটোগুলিও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল কি না। তা হয়নি জেনে বিচারপতি অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘ওই কমিশনারেটের ট্রাফিক বিভাগের ডেপুটি কমিশনারের কাছে জানতে চাইব, কেন অটোগুলি বাজেয়াপ্ত করা হয়নি?’’ একই সঙ্গে বিচারপতি দত্ত এ দিন পর্যবেক্ষণ করেন, ‘‘ব্যারাকপুরেই যদি এমন হয়, তা হলে তো অন্য কমিশনারেটগুলির জন্যও কোনও নির্দেশ জারি করতে হতে পারে।’’ বিচারপতি দত্ত বলেন, ‘‘দু’ধরনের বিষয় হতে পারে। এক ধরনের অটো, যাদের চালানোর বৈধ পারমিটই নেই। অন্য ধরনের অটো, যাদের নির্দিষ্ট একটি রুটে চালানোর অনুমতি রয়েছে। কিন্তু সেগুলি অন্য রুটে চলে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে চালকের লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করলেও, গাড়ি বাজেয়াপ্ত না-ও হতে পারে। কিন্তু যাদের চালানোর অনুমতিই নেই। তাদের ক্ষেত্রে পুলিশ কী করছে?’’ এ দিন বিচারপতি দত্ত ব্যারাকপুরের ডিসি (ট্রাফিক)-কে নির্দেশ দিয়েছেন, কেন ওই অটোগুলি বাজেয়াপ্ত করা হয়নি, তা ১৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জানাতে হবে। জেসি-কেও রিপোর্ট দিতে হবে, বেআইনি অটোর ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নিয়মিত অভিযানের নির্দেশও দেন তিনি।
প্রশ্ন উঠেছে, পারমিট ছাড়া অটো বিক্রিই হওয়ার কথা নয়। তা হচ্ছে কী করে? পরিবহণ-কর্তারা জানাচ্ছেন, সাধারণ ভাবে পারমিটের অফার লেটার পেলেই অটো কেনা যায়। তার পরে রেজিস্ট্রেশন এবং পারমিট হয়। ওই কর্তা বলেন, “কিন্তু সরকারি নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের চাপে বিভিন্ন ডিলারেরা বেআইনি ভাবে অটো বিক্রি করে। দালাল ধরে সেই রেজিস্ট্রেশনও হয়। তার পরে ইউনিয়নের নেতাদের দাক্ষিণ্যে নির্দিষ্ট রুটে সেটি চলতে শুরু করে।” কলকাতায় এখনও পারমিট ছাড়া কয়েক হাজার অটো রয়েছে বলে দাবি পরিবহণ-কর্তাদের। এ ছাড়া, এক রুটের পারমিট থাকলেও ইউনিয়ন নেতাদের ধরে অন্য রুটে চালানো কিংবা একটি রুটকেই অনেক রুটে চালানোর ঘটনা তো রয়েইছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy