ছেলের মৃতদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মা। ছবি: দীপঙ্কর দে।
ইট পাতা তস্য গলি হয়ে রং-চটা বাড়িটার সামনে দাঁড়াতেই কান্না ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছিল ক্ষোভ।
বাইরে পড়শিদের ভিড়। বাড়ির ভিতরে সদ্য স্বামীহারা রুবি রায়ের চোখের জল বাঁধ মানছিল না। তার মধ্যেই একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন, ‘‘কী করে আমাদের দিন কাটবে? আড়াই বছরের ছোট ছেলে রয়েছে। শ্বশুর-শাশুড়ি রয়েছে। স্বামীর একার রোজগার ছিল। আমরা ওদের (হাসপাতাল) টাকা মিটিয়ে দিতাম। ওদের (হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ) কি ভাইবোন নেই? একবারও ভাবল না? মানুষ এত নিষ্ঠুর!’’
ডানকুনির নন্দনকাননের বাসিন্দা সঞ্জয় রায়ের (৩০) মৃত্যুর খবর আগের রাতেই (বৃহস্পতিবার) জেনে গিয়েছিলেন স্থানীয়েরা। এলাকার জনপ্রিয় যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যুতে রাতে অনেকেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি। শুক্রবার সকালে তাঁরা জানতে পারলেন, কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালের ‘অমানবিক মুখ’-এর কথা। তাঁরা আশ্চর্য— এক দিন আগেই, গত বুধবার কলকাতার টাউন হলে এক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অ্যাপোলো হাসপাতালের বিরুদ্ধে বেশি বিল করা নিয়ে তোপ দেগেছিলেন। তার পরেও সেই হুঁশিয়ারিকে কী করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব না দিয়ে মুনাফার দিকেই নজর রাখলেন— প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।
ডানকুনির একটি বেসরকারি সিমেন্ট কারখানার কর্মী সঞ্জয় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি মোটরবাইকে কাজে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনায় পেটে গুরুতর আঘাত পান। হাওড়ায় একটি হাসপাতাল হয়ে তাঁকে কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানেই অস্ত্রোপচার হয়। কিন্তু অবস্থার বিশেষ উন্নতি না হওয়ায় বৃহস্পতিবার সকালে পরিবারের লোকজন সঞ্জয়কে এসএসকেএম হাসপাতালে স্থানান্তরিত করানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাঁদের অভিযোগ, সঞ্জয়কে ছাড়া হয় রাতে। আর দিনভর বিল নিয়ে চলতে থাকে টানাপড়েন। রাত ১০টা নাগাদ এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তির দু’ঘণ্টা পরেই সঞ্জয় মারা যান।
সঞ্জয়ের বাড়ির লোকজনের অভিযোগ, শুধু দেরি করে ছাড়াই নয়, চিকিৎসাতেও গাফিলতি করেছে অ্যাপোলো। তাই সঞ্জয়ের মৃত্যু হয়। তাঁর দাদা শঙ্করের অভিযোগ, ‘‘অ্যাপোলো বলেছিল, অপারেশন ঠিক হয়েছে। ভাই ভাল আছে। তা হলে ভাই মারা যাবে কেন? এসএসকেএমের ডাক্তাররা জানান, ভাইয়ের পেট ভর্তি রক্ত ছিল। আমরা অ্যাপোলোর বিরুদ্ধে এফআইআর করব। ওরা সাত লক্ষেরও বেশি টাকা বিল করেছে।’’
সঞ্জয়ের দিদি সীমা বলেন, ‘‘ওরা বলেছিল, পুরো নগদ টাকা না পেলে ভাইকে ছাড়বে না। চেকের বিনিময়েও নয়। শেষ পর্যন্ত পুরো টাকাই দিতে হয়েছে।’’
বন্ধুর দুর্ঘটনার পর থেকেই অতনু মুখোপাধ্যায়, মানস সোম আর বিকাশ চক্রবর্তী আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন সঞ্জয় যাতে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। ওই পরিবারের থেকে ফিক্সড ডিপোজিটের কোনও কাগজপত্র চাওয়া হয়নি বলে এ দিন সংবাদমাধ্যমের কাছে দাবি করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ কথা শুনে গর্জে ওঠেন মানস। তাঁর দাবি, এসএসকেএমে স্থানান্তরিত করানোর সময়ে ওরা পোশাকের জন্যও ৮০০ টাকা নিয়েছে।
প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্র এ দিন ওই পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। আজ, শনিবার সঞ্জয়ের বাড়িতে যাওয়ার কথা তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘এক ধরনের বেসরকারি হাসপাতাল সাধারণ মানুষের উপরে তোলাবাজি, গুন্ডাবাজি করছে। চাপে পড়ে ওরা (অ্যাপোলো) এখন টাকা ফেরত দেবে বলছে। কিন্তু প্রাণের বিনিময়ে কিছু হয় নাকি! প্রাণ তো ওরা ফেরত দিতে পারবেন? সঞ্জয়ের বাড়ির লোকজনকে নিয়ে কালীঘাটে দিদির (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) বাড়িতে যাব। এর বিহিত দরকার।’’ রুবি জানান, স্বামীর মৃত্যুর যথাযথ তদন্তের আর্জি জানাবেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy