Advertisement
১৯ মে ২০২৪

মদের ঘোরে কি সলিলসমাধি, তরুণীর অপমৃত্যু ঘিরে রহস্য

ঠিক যেন গোয়েন্দা সিরিয়াল ‘সিআইডি’-র দৃশ্য। হাওড়ার কোনা এক্সপ্রেসওয়ের ধারে একটি অভিজাত ক্লাবের সুইমিং পুলে রবিবার চলছিল ‘ফ্রেন্ডশিপ ডে পার্টি’। তখন সন্ধে সাড়ে সাতটা বেজে গিয়েছে। চড়া বাজনা, গানের সঙ্গে উদ্দাম নাচ চলছে। তরুণ-তরুণী সব মিলিয়ে প্রায় চারশো। তুমুল খানাপিনাও জারি। হঠাৎ সব আওয়াজ থেমে কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা। তার পরেই কয়েক জনের চিৎকার।

উদ্দাম পার্টির চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে সোমবারও। হাওড়ার সেই ক্লাবের সুইমিং পুলের ছবিটি তুলেছেন দীপঙ্কর মজুমদার। ইনসেটে শুভাঞ্জিতা।

উদ্দাম পার্টির চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে সোমবারও। হাওড়ার সেই ক্লাবের সুইমিং পুলের ছবিটি তুলেছেন দীপঙ্কর মজুমদার। ইনসেটে শুভাঞ্জিতা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৪ ০৩:১৭
Share: Save:

ঠিক যেন গোয়েন্দা সিরিয়াল ‘সিআইডি’-র দৃশ্য।

হাওড়ার কোনা এক্সপ্রেসওয়ের ধারে একটি অভিজাত ক্লাবের সুইমিং পুলে রবিবার চলছিল ‘ফ্রেন্ডশিপ ডে পার্টি’। তখন সন্ধে সাড়ে সাতটা বেজে গিয়েছে। চড়া বাজনা, গানের সঙ্গে উদ্দাম নাচ চলছে। তরুণ-তরুণী সব মিলিয়ে প্রায় চারশো। তুমুল খানাপিনাও জারি।

হঠাৎ সব আওয়াজ থেমে কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা। তার পরেই কয়েক জনের চিৎকার। একটু পরে দেখা গেল, সুইমিং পুল থেকে এক তরুণীর নিথর দেহ তুলে আনছেন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাউন্সারেরা।

প্রথমে পার্টির উদ্যোক্তারাই কৃত্রিম ভাবে ওই তরুণীর শ্বাসপ্রশ্বাস চালু করার চেষ্টা চালালেন কিছু ক্ষণ। কাজ না হওয়ায় ওই তরুণীকে নিয়ে যাওয়া হল হাওড়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখান থেকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। বন্ধুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব দিবস উদযাপনের পার্টিতে আনন্দ করতে গিয়ে প্রাণ হারালেন শুভাঞ্জিতা বসাক (২৫)। গড়িয়া থেকে হাওড়ার ওই ক্লাবের পার্টিতে যোগ দিতে যান তিনি।

পুলিশের দাবি, ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট বলছে, জলে ডুবে ওই তরুণীর মৃত্যু হয়েছে এবং তাঁর পাকস্থলীতে পাওয়া গিয়েছে প্রচুর অ্যালকোহল। দেহে প্রাথমিক ভাবে আঘাতের চিহ্ন নেই। এর থেকে তদন্তকারীদের একাংশের ধারণা, প্রচুর মদ্যপান করে ওই তরুণী সুইমিং পুলে নেমে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। মদের ঘোরে ছিলেন বলে জল থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারেননি। ডোমজুড় থানার পুলিশ অস্বাভাবিক মৃত্যুর একটি মামলা রুজু করেছে। গোটা ঘটনায় ক্লাব কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

শুভাঞ্জিতার স্বামী সম্রাট সরেল (বাঁ দিকে) এবং বন্ধু
রোহিত ত্রিপাঠী ও প্রিয়াঙ্কা ভট্টাচার্য। ডোমজুড় থানায়। —নিজস্ব চিত্র

কিন্তু ক্লাব কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এমনিতে ওই পুলের গভীরতা প্রায় পাঁচ ফুট হলেও পার্টি হবে বলেই নিরাপত্তার কথা ভেবে রবিবার তিন ফুটের বেশি জল রাখা হয়নি। ওইটুকু জলে ডুবে কি এক জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মৃত্যু হতে পারে, প্রশ্ন তাঁদের।

পুলিশ ও চিকিৎসকদের একাংশ অবশ্য বলছেন, এমনটা হওয়া সম্ভব। পুলিশ ও ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলে, ‘শ্যালো ওয়াটার ড্রাউনিং’। অনেক সময়ে এর চেয়ে কম গভীর জলে-নর্দমায় পড়ে মদ্যপের মৃত্যুর উদাহরণ দিচ্ছেন তদন্তকারীরা। ওই সব ক্ষেত্রে উপুড় হওয়া অবস্থাতেই মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে পুলিশ প্রাথমিক ভাবে জেনেছে, রবিবার সন্ধ্যায় ক্লাবের ওই পুলে শুভাঞ্জিতাকে উপুড় হয়েই পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল।

পুলিশের একাংশের দাবি, ওই তরুণীর ব্যাগে ঘুমের কড়া ওষুধও মিলেছে। ওই জাতীয় ওষুধ মদের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে তুমুল নেশা হয়। কিন্তু শুভাঞ্জিতা রবিবার পার্টি চলাকালীন মদের সঙ্গে ওই ওষুধ মিশিয়ে খেয়েছিলেন কি না কিংবা কেউ তাঁকে খাইয়েছিলেন কি না, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট থেকে তা বোঝা যাবে না। আগামী ২০ দিনের মধ্যে ভিসেরা পরীক্ষা করা হলে সেটা জানা সম্ভব। আর এই ব্যাপারে নিশ্চিত হতে মৃতদেহের ভিসেরা পরীক্ষাই করাতে দিয়েছে পুলিশ। কেউ তাঁকে অত্যধিক মদ্যপান করিয়েছিল বা মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল কি না, সেটাও তদন্তকারীরা খতিয়ে দেখছেন।

২০১১ সালে শুভাঞ্জিতার বিয়ে হয় সম্রাট সরেল নামে এক সরকারি অফিসারের সঙ্গে। তাঁর বাড়ি বেলেঘাটা এলাকায়। তবে গত আট মাস যাবৎ ওই তরুণী গড়িয়ার শ্রীরামপুর রোডের একটি বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকছিলেন। শুভাঞ্জিতা ছোটবেলায় তাঁর মাকে হারান। ২০০৪-এ মারা যান তাঁর বাবাও। পুলিশ জেনেছে, রবিবার কোনা এক্সপ্রেসওয়ের ধারে ওই ক্লাবের পুল-পার্টিতে শুভাঞ্জিতার সঙ্গে গিয়েছিলেন তাঁর রুমমেট প্রিয়াঙ্কা ভট্টাচার্য এবং রোহিত ত্রিপাঠী নামে এক যুবক। পুলিশের বক্তব্য, পার্টির আয়োজকদের অন্যতম, অভিষেক সিংহ নামে এক যুবকের সঙ্গেও প্রিয়াঙ্কার বন্ধুত্ব ছিল। অভিষেক অবশ্য দাবি করেছেন, শুভাঞ্জিতা ও রোহিতকে তিনি চিনতেন না, তবে প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। অভিষেকের বক্তব্য, তিনি ও তাঁর দুই বন্ধু মিলে ওই পার্টির আয়োজন করেছিলেন। প্রিয়াঙ্কা ছিলেন তাঁর অতিথি। প্রিয়াঙ্কাই সঙ্গে করে রোহিত ও শুভাঞ্জিতাকে নিয়ে যান বলে অভিষেকের দাবি। পুলিশ জেনেছে, রোহিতের সঙ্গে প্রিয়াঙ্কার বন্ধুত্ব হয় একটি সোশ্যাল নেটওয়র্কিং সাইট-এর মাধ্যমে। অভিষেক জানান, এর আগে তাঁরা তিন বন্ধু ছোটখাটো পার্টির আয়োজন করলেও এত বড় মাপের অনুষ্ঠান করেননি। তাঁর কথায়, “আমাদের সামর্থ্য ছাড়িয়ে বাউন্সার ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক রেখেছিলাম। প্রায় ২৫ জন বাউন্সার ছিল।”

পার্টি শুরু হয় বেলা তিনটেয়। অভিষেকের বক্তব্য, সাড়ে চারটে আসেন শুভাঞ্জিতা, প্রিয়াঙ্কা ও রোহিত। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ ওই কাণ্ড। কিন্তু শুভাঞ্জিতা কখন, কী ভাবে জলে ডুবে গেলেন, সেটা তাঁরা খেয়াল করেননি বলে প্রিয়াঙ্কা ও অভিষেকের দাবি। একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরতা প্রিয়াঙ্কার কথায়, “পার্টিতে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছিলাম। ও (শুভাঞ্জিতা) কোথায় কী করছিল, তা আমি জানি না।” অভিষেকের বক্তব্য, পার্টিতে ঢোকার সময়ে প্রিয়াঙ্কাই শুভাঞ্জিতার সঙ্গে তাঁর আলাপ করান। পার্টি চলাকালীন শুভাঞ্জিতাকে তিনি খেয়াল করেননি। দ্বিতীয় বার শুভাঞ্জিতাকে তিনি দেখতে পান ওই তরুণীর নিথর দেহ উদ্ধারের পর। যদিও অভিষক দু’বার বার পুল-লাগোয়া বার কাউন্টার থেকে শুভাঞ্জিতাকে বিয়ার নিতে দেখেছেন বলে তদন্তকারীদের জানিয়েছেন।

শুভাঞ্জিতার অপমৃত্যুর ঘটনায় তাঁর পরিজনেরা পার্টির উদ্যোক্তা এবং ওই ক্লাব কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলেছেন। তরুণীর স্বামীর প্রশ্ন, “এত বড় ক্লাবে ঠিক মতো নজরদারির ব্যবস্থা নেই কেন?” সেই সঙ্গে সম্রাটবাবুর বক্তব্য, “এত লোকের মধ্যে শুধু ওর (শুভাঞ্জিতা) সঙ্গেই কেন এমন ঘটল, সেটাও দেখা দরকার।” শুভাঞ্জিতার স্বামী জানান, আট মাস যাবৎ তাঁর স্ত্রী আলাদা থাকলেও তাঁদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সম্রাটবাবুর বক্তব্য, তাঁর স্ত্রী বিসিএ (ব্যাচেলর অব কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন) পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ওই সরকারি অফিসার জানান, মনোমালিন্যের কারণে শুভাঞ্জিতা আলাদা ছিলেন। ফেরানোর চেষ্টা চলছিল।

প্রিয়াঙ্কার দাবি, “শুভাঞ্জিতার সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আট মাস ও আমার সঙ্গে এক ঘরে ছিল। কিন্তু নিজের কথা কিছুই পরিষ্কার করে বলেনি।” যাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতেন না, তাঁকে কী করে প্রিয়াঙ্কা পার্টিতে নিয়ে গেলেন, তদন্তকারীদের একাংশ তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

ওই ক্লাবের অন্যতম শীর্ষকর্তা সম্রাট আহমেদের দাবি, পার্টি চলার জন্য যাবতীয় নিয়ম ও সতর্কতা মানা হয়েছিল। সুইমিং পুলে জলের উচ্চতা পাঁচ ফুট থেকে তিন ফুট করা হয়েছিল। পুলের পাশে বাউন্সারও ছিল। কিন্তু এ সব ক্ষেত্রে ‘লাইফ সেভার’ বা দক্ষ সাঁতারু মোতায়েন রাখতে হয়, যাঁরা সব সময়ে নজরদারি চালাবেন ও কাউকে ডুবতে দেখলেই ঝাঁপিয়ে বাঁচাবেন। তা ছাড়া ওই পুলে চারশো জনের নামাটা কতটা যুক্তিযুক্ত ও নিরাপদ, পুলিশ খতিয়ে দেখছে।

শুধু তা-ই নয়, পুলিশ সূত্রের খবর, এ দিন পুল থেকে প্রচুর খালি মদের বোতল ও বিয়ারের ক্যান মিলেছে। তা হলে কি পার্টি চলাকালীন পুলেই খানাপিনার আসর বসেছিল?

ক্লাবকর্তা বলছেন, “পুলের ভিতরে খানাপিনা নিষেধ। তবে ওই পার্টিতে অনেকে জলে নেমে মদ্যপান করছিলেন বলে শুনেছি। কেন এমন হল, তা খোঁজ নিয়ে দেখছি।” অর্থাৎ সেই সময়ে ক্লাবের তরফে যে ঠিক মতো নজরদারি করা হয়নি, সেটা ক্লাবকর্তার কথা থেকেই পরিষ্কার।

পার্টিতে আসা এক তরুণী অনুষ্কা সিংহ জানান, সন্ধ্যায় পার্টি চলাকালীন হঠাৎই গান থেমে যায়। এক জন জলে পড়ে গিয়েছে বলে চিৎকারও শুরু হয়ে যায়। অনুষ্কার কথায়, “দেখলাম, এক জন বাউন্সার একটি মেয়েকে জল থেকে তুলে ড্রেসিং রুমে নিয়ে গেল। ওইটুকু জলে কী ভাবে মেয়েটা পড়ে গিয়েছিল, সেটা অবশ্য জানি না।” অভিষেক বলেন, “পুল ঘিরে সিসি ক্যামেরা বসালে গোপনীয়তা খর্ব হবে বলে সেই ব্যবস্থা ছিল না।” অভিষেক জানান, ক্লাবের নিজস্ব চিকিৎসক রয়েছেন শুনে পার্টির আয়োজকেরা আলাদা করে কোনও ডাক্তার রাখেননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE