Advertisement
০২ মে ২০২৪

হকার-দাপটে স্টেশনে ঠাঁই নেই যাত্রীদের

রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে এক জন হাঁক দিচ্ছিলেন, ‘দেব নাকি ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে!’ পলিথিনের উপরে ছড়ানো রয়েছে শশা এবং নুনের কৌটো। অন্য দোকানিরাও খদ্দের টানতে পিছিয়ে নেই। কারও ডালায় আম, লিচু, তরমুজ তো কারও কড়াইতে তৈরি হচ্ছে পরোটা। দেদার বিকোচ্ছে চা-সিগারেট-গুটখা। কেউ বেচছেন পাঁঠার মাংস।

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই। পান্ডুয়া স্টেশনে ঢোকার রাস্তার অবস্থা এমনই। নিজস্ব চিত্র।

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই। পান্ডুয়া স্টেশনে ঢোকার রাস্তার অবস্থা এমনই। নিজস্ব চিত্র।

প্রকাশ পাল এবং সুশান্ত সরকার
চুঁচুড়া ও পান্ডুয়া শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৬ ০২:০৯
Share: Save:

রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে এক জন হাঁক দিচ্ছিলেন, ‘দেব নাকি ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে!’

পলিথিনের উপরে ছড়ানো রয়েছে শশা এবং নুনের কৌটো। অন্য দোকানিরাও খদ্দের টানতে পিছিয়ে নেই। কারও ডালায় আম, লিচু, তরমুজ তো কারও কড়াইতে তৈরি হচ্ছে পরোটা। দেদার বিকোচ্ছে চা-সিগারেট-গুটখা। কেউ বেচছেন পাঁঠার মাংস।

শহরের কোনও বাজার নয়, হাওড়া-বর্ধমান মেন শাখার চুঁচুড়া স্টেশন চত্বর এ ভাবেই সরগরম থাকে হকারদের হাঁকডাকে। ডালা আর ভিড় সামলে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছতে সমস্যায় পড়েন নিত্যযাত্রীরা।

সম্প্রতি প্ল্যাটফর্ম থেকে অবৈধ হকারদের উচ্ছেদ অভিযানকে কেন্দ্র করে রেল কর্তৃপক্ষ ও হকারদের মধ্যে সংঘর্ষে কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল বারুইপুর স্টেশন। ছোড়া হয় বোমাও। প্রহৃত হন রেলের উচ্চপদস্থ আধিকারিক। রেল চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। নাকাল হতে হয় সাধারণ যাত্রীদের। প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়ে আপাতত ওই স্টেশনে হকার উচ্ছেদ অভিযান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রেল কর্তৃপক্ষ।

বারুইপুরের ঘটনার পরে অন্যান্য স্টেশনগুলিতে হকার উচ্ছেদ নিয়ে ধীরে পা ফেলতে চাইছে রেল। ফলে রেলযাত্রীদের দুর্ভোগ কমার কোনও আশা দেখছেন না রেলযাত্রীরা।

হুগলি জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলিতে কী ভাবে চলছে হকার রাজ?

হুগলির জেলা সদর চুঁচুড়া। প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন প্রান্ত এবং জেলার বাইরে থেকেও অসংখ্য মানুষ ট্রেন ব্যবহার করেন। কিন্তু চুঁচুড়া স্টেশন চত্বরে সকাল-সন্ধ্যায় হকারদের দাপটে হাঁটাই দায়। স্টেশনে ঢোকার মুখে রেলের জমি দখল করে গজিয়ে উঠেছে একাধিক সাইকেল স্ট্যান্ড, চায়ের দোকান, হোটেল। স্টেশনে ওঠার মুখে অটোস্ট্যান্ড লাগোয়া রেলের জমিতে গজিয়ে উঠেছে একের পর এক দোকান। সব্জি থেকে পাঁঠার মাংস—কী নেই সেখানে! শুধু বাজার এবং সাইকেল স্ট্যান্ড নয়, রেলের জমিতেই তৈরি হয়েছে শনিমন্দির। সেখানে নিয়মিত পুজোপাঠ চলে।

কলকাতায় একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী অরূপ মণ্ডল প্রতি দিন চুঁচুড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরেন। তাঁর অভিযোগ, ‘‘হকারদের জন্য ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনে হাঁটার জায়গা পাওয়া যায় না।’’ অন্য এক অফিসযাত্রীর আক্ষেপ, ‘‘দিনের পর দিন তো এভাবেই যাই-আসি। আমাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে।’’

প্রায় একই ছবি পান্ডুয়া স্টেশন চত্বরে। কয়েক দশক ধরেই এই স্টেশনে বাজার বসছে। নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ, হকারদের ডালা সামলে স্টেশনে ঢুকতে দেরি হওয়ায় ট্রেন ধরতে না পারার ঘটনাও ঘটেছে। অফিস-টাইমে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, খুদেদের পক্ষে এই স্টেশনে যাতায়াত করা কার্যত অসাধ্য।

নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ, রেল কর্তৃপক্ষ নজর না দেওয়াতেই রেলের জমিতে বেআইনি ভাবে একের পর এক গুমটি এবং দোকান গজিয়ে উঠেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক জন হকার জানান, রেলের উচ্চপদস্থ কর্তারা স্টেশন পরিদর্শনে এলে তাঁদের উঠে যেতে বলা হয়। পরিদর্শন শেষে ফের দোকান সাজিয়ে বসে পড়েন তাঁরা। এক হকারের কথায়, ‘‘বহু বছর ধরেই আমরা এখানে ব্যবসা করছি। রেলের তো অনেক জায়গা রয়েছে। কিন্তু আমাদের উচ্ছেদ করলে খেতে না পেয়ে মারা পড়ব।’’

শুধু কি স্টেশন চত্বরে গজিয়ে ওঠা দোকান? পা‌ন্ডুয়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম এবং স্টেশন চত্বর মদ, গাঁজা-সহ নিষিদ্ধ মাদক সেবনের জায়গা বলেও অভিযোগ। ছোট গুমটির আড়ালে মদ-গাঁজার রমরমা চলে। ১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম এবং ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মের এক দিকে হেরোইনের নেশা চলে। সব জেনেও আরপিএফ কিংবা স্টেশন কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ। পাণ্ডুয়ার বাসিন্দা অভিজিৎ ‌নন্দী, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া পলশ্রী মুখোপাধ্যায়, স্থানীয় ব্যবসায়ী সুরজিৎ সাহার ক্ষোভ, ‘‘কাজের সূত্রে নিয়মিত কলকাতা যাই। কিন্তু পান্ডুয়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে হকারদের দাপটে ওঠানামা করা দুঃসাধ্য।’’ এক নিত্যযাত্রীর প্রশ্ন, ‘‘টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ট্রেনে চাপতে হয়। কিন্তু যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য অবহেলিত থাকবে কেন?’’ নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ, রেল পুলিশ, আরপিএফ এবং রেল কর্মীদের একাংশের বোঝাপড়াতেই চলে এই কারবার।

মাস কয়েক আগে মগরা এবং পান্ডুয়া স্টেশনের হকারদের সরে যাওয়ার জন্য রেলের তরফে নোটিস দেওয়া হয়েছিল। তার পরেই হকাররা আন্দোলন শুরু করেন। তাঁদের পরিবারের লোকজন স্টেশন চত্বরে পুনর্বাসনের দাবিতে অবস্থান শুরু করেন। এর পরে রেল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আর এগোয়নি। রেল কর্তাদের বক্তব্য, রাজনৈতিক দলগুলি সহযোগিতা করলে হকার উচ্ছেদ করতে সমস্যা হবে না। কিন্তু ভোটের অঙ্ক ভেবেই রাজনৈতিক নেতারা চুপ থেকে সমস্যা জিইয়ে রাখেন।

আইএনটিটিইউসি এবং সিটু দুই শ্রমিক সংগঠনেরই অবশ্য বক্তব্য, হকার উচ্ছেদ খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। হকারদের উচ্ছেদের আগে তাঁদের পরিবারের কথাও ভাবা উচিত। পুর্নবাসন না দিয়ে হকার উচ্ছেদ করতে গেলে প্রতিবাদ হবেই। আইএনটিটিইউসির জেলা সভাপতি বিদ্যুৎ রাউতের দাবি, ‘‘এই হকারদের বিকল্প জায়গায় সরানোর জন্য আলোচনা চলছে।’’ জেলা সিটু নেতা প্রদীপ সাহার দাবি, দীর্ঘদিন ধরেই তারা সংগঠনগতভাবে হকারদের রেলের জমিতেই নির্দিষ্ট জায়গা এবং পরিচয়পত্র দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছি।

পূর্ব রেলে মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র বলেন, ‘‘অনেক স্টেশনেই হকারের সংখ্যা বাড়ছে। হকার তুলতে গিয়ে রেল কর্মীরা আক্রান্তও হয়েছেন। কী ভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে সে নিয়ে আলোচনা চলছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hawker railway platform
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE