Advertisement
০৬ মে ২০২৪

বেআইনি পুলকারের রমরমা হুগলিতে

দেখলে মুরগির খাঁচা বলে ভ্রম হয়। ঘুপচি জানলা দিয়ে হাওয়া ঢোকে না। দু’দিকের আসনে ভাল করে বসা যায় মেরেকেটে চার অথবা পাঁচ জন। কিন্তু গাদাগাদি করে সাত জন বসানো হয়েছে। আর উল্টো দিকের সিটেও সাত। মাঝের বেঞ্চে আরও সাত।

খাঁচাবন্দি পড়ুয়ারা। পান্ডুয়ার তেলিপাড়ায় ছবিটি তুলেছেন সুশান্ত সরকার।

খাঁচাবন্দি পড়ুয়ারা। পান্ডুয়ার তেলিপাড়ায় ছবিটি তুলেছেন সুশান্ত সরকার।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৬ ০১:০৯
Share: Save:

দেখলে মুরগির খাঁচা বলে ভ্রম হয়। ঘুপচি জানলা দিয়ে হাওয়া ঢোকে না। দু’দিকের আসনে ভাল করে বসা যায় মেরেকেটে চার অথবা পাঁচ জন। কিন্তু গাদাগাদি করে সাত জন বসানো হয়েছে। আর উল্টো দিকের সিটেও সাত। মাঝের বেঞ্চে আরও সাত। পা রাখার জায়গা মেলা ভার। গাড়ির পাদানিও অনেকটাই উঁচুতে। গাড়ি থামলে বাচ্চাদের লাফিয়ে নামতে হয়। সেই লাফের জন্য বাবা-মায়েরা আতঙ্কে থাকেন। বাচ্চা না ফেরা পর্যন্ত রোদ, বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাস্তায় হ্যাঁ-পিত্যেশ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাঁদের।

কখন কী হয়? কেন না, এখন তস্য গলিতেও চার চাকা আর মোটর বাইকের দাপাদাপি। এই আতঙ্কই দাম দিয়ে কিনতে হয়। মাথা পিছু মাসের শেষে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। ‘পুলকারে’র এই চ্ছলছবি সারা হুগলি জুড়েই কমবেশি সত্যি।

পশ্চিমবঙ্গে ইদানিং একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে পর পর কয়েকটি পুলকার দুর্ঘটনার পরে প্রশাসনের টনক নড়ে। নিয়মভাঙা স্কুলগাড়ি কিংবা স্কুলবাসের ধরপাকড়ের উপর সাময়িক জোর দেয় সরকার। কিন্তু তাতেও যে পরিস্থিতি তেমন একটা বদল হয় না তা বলাই বাহুল্য। বেশ কিছু স্কুলের কর্তৃপক্ষ জানান, তাঁরা চান না ছেলেমেয়েরা পুলকারে যাতায়াত করুক। কিন্তু অভিভাবকদের একাংশের বক্তব্য, অন্য উপায় না থাকাতেই পুলকারে ছেলেমেয়েদের পাঠাতে হয়।

রাজ্য সরকারের নির্দেশিকা রয়েছে, বৈধ অনুমতি নেই এমন গাড়ি পুলকার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। দশ বছরের পুরনো কোনও গাড়ি বা হাল্কা ছাদের গাড়ি পুলকার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। পুলকার হিসেবে ব্যবহৃত গাড়ির জন্য প্রতি বছর ‘ফিটনেস সার্টিফিকেট’ জমা দিতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, পুলকারে পানীয় জল, ফাস্ট এইড বক্স-সহ প্রয়াজনীয় সরঞ্জাম রাখা বাধ্যতামূলক। পুলকার চালানোর সময়ে মোবাইলে কথা বলতে পারবেন না চালক। গাড়ি চালকদের ক্ষেত্রে আর্দশ কিছু আচরণ বিধি রয়েছে (নেশা করে গাড়ি চালানো যাবে না)। কিন্তু সেই সব খুঁটিনাটি নিয়ম আদপেই মানা হয় না বলেই অভিভাবকদের অভিযোগ।

হুগলির ব্যান্ডেল, শ্রীরামপুর, উত্তরপাড়া, চুঁচুড়া, চন্দননগর, বাঁশবেড়িয়া, পান্ডুয়া-সহ নানা জায়গায় পুলকার চলে। অভিযোগ, অনেক জায়গাতেই চার চাকার গাড়িতেই পেট্রোলের বদলে রান্নার গ্যাস ভরা হয়। এই সমস্ত পুলকার মালিকদের বক্তব্য, ‘‘স্কুল পড়ুয়াদের পৌঁছে দিয়ে বেশি টাকা পাওয়া যায় ‌না। ফলে পোট্রোল খরচ ওঠে না। সেই কারণে লাভের মুখ দেখতেই বেআইনি জেনেও রা‌ন্নার গ্যাসে গাড়ি চালানো হয়।’’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাঁশবেড়িয়ার এক পুলকার চালক বলেন,‘‘আমার একটি পুলকার রয়েছে। সেটি ভাড়া খাটাই। কিন্তু তা থেকে আয়ের মুখ খুব একটা দেখতে পাই না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়া বাবদ যে টাকা পাই, তাতে তেমন লাভ হয় না। সে জন্য কখনও কখনও রান্নার গ্যাসে গাড়ি চালাতে হয়।’’ পান্ডুয়ার এক পুলকার চালকের বক্তব্য, ‘‘কী করব? প্রতিযোগিতার বাজার। সব নিয়ম মানা যায় না! ব্যবসায় টিঁকে থাকতে তো হবে।’’ সূত্রের খবর, বহু ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য কেনা গাড়ি পুলকার হিসেবেও ভাড়া খাটানো হয়। এতে সরকারের রাজস্ব কমছে।

শুধু কি চার চাকার গাড়ি?

‘পুলকার’ হিসেবে দিব্যি চলছে ভ্যানো বা রিকশা। একটা রিকশায় ছ-সাত জন শিশুকে নিয়ে যাওয়া হয়। সামনের হ্যান্ডেলে বাচ্চাকে বসিয়ে নেন রিকশাচালক। ভ্যান গাড়িতেও খাঁচা লাগিয়ে দিব্যি চলে ‘স্কুলভ্যান’। তাতে গাদাগাদি করে যাতায়াত করে বাচ্চারা। ব্যান্ডেলের একটি ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রের কথায়, ‘‘কাকু জোরে গাড়ি চালালে আমরা আস্তে চালাতে বলি। কাকু কথা শোনে না। উল্টে বলে, ‘চুপ করে বস’।’’

শ্রীরামপুরের একটি স্কুলের পরিচালন কমিটির সদস্যার বক্তব্য, ‘‘আমাদের স্কুলের নিজস্ব বাস রয়েছে। তাতেই বাচ্চারা যাতায়াত করে। একই বাসে শিক্ষক-শিক্ষিকারাও অনেকেই স্কুলে আসেন। স্কুলবাস অনেক বেশি নিরাপদ। কিন্তু কিছু অভিভাবক যে কোনও কারণেই হোক, বাচ্চাদের পুলকারে স্কুলে পাঠান। আমরা তা চাই না। কিন্তু অভিভাবকদের ভিন্নমত থাকতেই পারে।’’

এই পরিস্থিতি বদলাতে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা কী?

জেলার পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী অবশ্য আশ্বস্ত করে বলেন, ‘‘স্কুলপড়ুয়া এবং অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে জেলার চারটি মহকুমাতেই সেমিনার করা হয়েছে। জেলায় পথ নিরাপত্তা সপ্তাহ পালন করা হচ্ছে। আমরা মনে করি স্কুল পর্যায় থেকে সচেতনতা বাড়াতে কাজ শুরু করা উচিত।’’ তাঁর সংযোজন-‘‘নিয়মভাঙা গাড়ির বিরুদ্ধে বছর ভর রুটিনমাফিক অভিযান চালানো হয়। নির্দিষ্ট ধারায় মামলাও করা হয়।’’ প্রশাসন, স্কুল কর্তৃপক্ষ, অভিভাবকেরা নানা উদ্যোগের কথা বলছেন। কিন্তু এই সবের মাঝে দুর্ঘটনার তালিকা বছরভর বাড়তেই থাকছে। মুখ্যমন্ত্রীও ইদানিং পথ নিরাপত্তার প্রশ্নে উদ্বিগ্ন। সরকারি স্তরে নানা কর্মসূচির কথা শোনা যাচ্ছে এখন প্রশ্ন?

কোনও দাওয়াইয়ে স্কুলের বাচ্চারা নিরাপদে যাতায়াত করতে পারবে এই রাজ্যে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pull car
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE