শ্রীরামপুরের মাহেশ জগন্নাথ ঘাট লেনের মণ্ডপসজ্জায় শ্রমিকের কাহিনি।— নিজস্ব চিত্র
ছোট্ট শহরটার এক দিকে মাথা তুলেছে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির! অন্য দিকে ‘নির্মল গ্রাম’!
কোথাও দেখা যাচ্ছে নাটমন্দির, কোথাও নারী নির্যাতনের নানা কাহিনি!
প্রস্তুতি পর্ব সাঙ্গ। থিমের ডালি সাজিয়ে দর্শক টানা শুরু করে দিয়েছে গঙ্গাপাড়ের শহর শ্রীরামপুর। কার থিম সেরার সেরা? কার প্রতিমা দর্শকের চোখে পয়লা নম্বরে? আলোকসজ্জায় কে কাকে ছাপিয়ে যাবে? এই সব প্রশ্নের সমাধান হবে আগামী কয়েক দিনে। বৃহস্পতিবার থেকেই মণ্ডপে মণ্ডপে ঢল।
মাহেশ জগন্নাথ ঘাট লেনের (লক্ষ্মীঘাট) পুজোয় পেটের দাগিদে বেরনো মানুষের জীবন-সংগ্রাম তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে। সুন্দরবনের শ্বাপদসঙ্কুল জঙ্গলে মধু সংগ্রহ, মিন ধরা থেকে কল-কারখানায় হাড়ভাঙা খাটুনির রোজনামচা উঠে এসেছে এখানে। উদ্যোক্তাদের তরফে দিব্যেন্দু বালিয়াল জানান, আর রয়েছে পেল্লাই হাঁড়ি। যে হাঁড়িতে চাল চাপানোর জন্য প্রতি দিনের লড়াই!
স্বদেশি যুগের রক্তঝরা দিনে বাঙালি-শিখ মেলবন্ধন নিয়ে কত কাহিনি রয়েছে ইতিহাসে। দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে বাঙালির সঙ্গে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের সম্প্রীতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে মাহেশের নেহরুনগর সর্বজনীন। পুজো মণ্ডপ হিসেবে এ বার তারা গড়েছে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির। চতুর্থীর সন্ধ্যায় পুজোর উদ্বোধনে অংশগ্রহণ করলেন শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ। মণ্ডপের ভিতরে নিষ্ঠা ভরে ‘সতনাম’ও (শিখদের বিশেষ প্রার্থনা) করলেন। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে চলল শুভেচ্ছা বিনিময়। মণ্ডপে শিখ সম্প্রদায়ের নানা কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। সেই সব ছবির বিষয়বস্তু আম-দর্শককে বুঝিয়ে বলছে শিখ-কিশোররা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন আবহে পুজো উদ্যোক্তা থেকে স্থানীয় বাসিন্দা— সকলেই খুশি।
শান্তির বাণী নিয়ে হাজির মাহেশ কলোনি সর্বজনীন। প্রতিদ্বন্দ্বীদের টেক্কা দিতে তারা এ বার ভগবান বুদ্ধের শরণাপন্ন। ওড়িশার ধবলগিরির আদলে তৈরি মন্দিরে থাকছে বুদ্ধের জীবনের প্রতিচ্ছবি। তারাপুকুর মোড়ে আপনজনের পুজোর থিম ‘আমিও দুর্গা’। স্বর্গের দুর্গা যেখানে পুজো পান, সেখানে মর্ত্যের ‘দুর্গা’ নামের মেয়েরা কতটা সমাদৃতা? তাঁদের জীবন কাহিনিই নানা আঙ্গিকে ফুটে উঠেছে এই পুজোয়। পুজো কমিটির কর্তা উত্তম রায় জানান, সমাজের ‘সাধারণ দুর্গা’দের প্রাত্যহিক লড়াই তুলে ধরতে হস্তশিল্পের নানা কাজের ব্যবহার হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরের সামনে ১৯-এর পল্লির পুজোয় দুর্গা এ বার সেজে উঠেছেন বনদেবীর সাজে।
কাশী ডাক্তার লেনে ঐকতানের পুজোয় গাছ বাঁচানোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। শ্রীরামপুর স্টেশন সংলগ্ন গাঁধী ময়দানে ৫ ও ৬ এর পল্লিগোষ্ঠী ব্যবসায়ী সমিতির পুজোয় উঠে এসেছে মায়াপুরের ইস্কন মন্দির। সবুজের ডাক দিতে টবে কয়েকশো গাছ রাখা হচ্ছে। তারাপুকুর ২৮-এর পল্লিতে থিম হিসেবে উঠে এসেছে ‘নির্মল গ্রাম’। গ্রাম্য পরিবেশে ছৌ-নাচ প্রদর্শন করবেন পুরুলিয়ার শিল্পীরা। পাশের আদর্শ সমিতি গঙ্গাদূষণকে তুলে এনেছে থিম হিসেবে। লাইব্রেরি লেনের পুজোয় বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামের আদলে ৬টি নাটমন্দির থাকছে। তার পাশে মূল মন্দিরে মায়ের অর্চনা। টিনবাজার নয়ের পল্লির মণ্ডপে ঢোকার মুখে পেল্লাই দুর্গা। বিশালাকার দুর্গা মাহেশ কলোনি মহিলা সমিতির পুজোতেও। রিষড়ার সুভাষনগর মধ্যপাড়ায় সারস্বত সঙ্ঘের রজত জয়ন্তী বর্ষের পুজোর আকর্ষণ কৃষ্ণনগরের প্রতিমা। চক্রবর্তীপাড়ার আনন্দ পরিষদের পুজোর থিম, ‘নারী নির্যাতন’। কন্যাসন্তান হওয়ায় নারীকে যে গঞ্জনা সহ্য করতে হয়, বাল্যবিবাহ দেওয়ার পরিণতি, শ্বশুরবাড়িতে পণের দাবিতে অত্যাচার থেকে বৃদ্ধ বয়সে পরিজনদের কাছে গলাধাক্কা খাওয়ার করুণ কাহিনি মডেলের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে এখানে।
থিমের জোয়ারে ভাসছে শ্রীরামপুর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy