কার্টুন চরিত্র দিয়ে সাজছে থানা। —নিজস্ব চিত্র।
ঘরটি প্রায় ১০ ফুট লম্বা ৮ ফুট চওড়া হবে। ঘরের কোনও দেওয়ালে মিকি মাউস তো কোথাও ছোটা ভীম। এ সব কার্টুন চরিত্রের পাশাপাশি রয়েছে ব্যাট-বল। বাহারি চেয়ার-টেবিল। খাতায় আঁকিবুকি করা। দেখলে মনে ছোটদের খেলাঘর।
আদতে এটি কোনও খেলাঘর নয়। থানা। নানা কারণে থানায় আসতে হয় বালক-বালিকাদের। মাঝেমধ্যেই হারিয়ে যাওয়া, পাচার হয়ে যাওয়া শিশুদের এক রাতের ঠিকানা হয় থানা। একই কথা প্রযোজ্য কিশোর ‘অপরাধী’দের ক্ষেত্রেও। সব ক্ষেত্রেই শিশু-কিশোরদের থানার ভিতরে অফিসারদের পাশে বসিয়ে রাখাই দস্তুর। রাতে থানারই বেঞ্চ বা টেবিলে মশার কামড় খেয়ে ঘুমোতে হয়। পুলিশের দাপট, কখনও দুষ্কৃতীকে বেদম মার, পুলিশের গুঁতো খেয়ে চোরের চিৎকার সবই চোখের সামনে দেখতে হয়। থানা-পুলিশের এই পরিবেশ থেকেই সাধারণ বালক-বালিকা বা কিশোর ‘অপরাধী’দের আড়াল করতেই থানায় থানায় চাইল্ড ফ্রেন্ডলি কর্নার বা শিশু বান্ধব কর্নার তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। থানা চত্বরেই মূল ভবন থেকে কিছুটা দূরে ওই ঘর করতে বলা হয়েছে। থানা বা জেলের ধারণা যাতে শিশুমনে না পৌঁছয় সেই ভাবনা থেকেই এই সিদ্ধান্ত। শিশুবান্ধব কর্নার তৈরির জন্য জেলা সমাজকল্যাণ দফতরের তরফে সংশ্লিষ্ট থানাকে এককালীন তিন হাজার টাকা দেওয়ার কথা। সম্প্রতি শ্রীরামপুর থানায় শিশুবান্ধব কর্নার করা হয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন জেলাতেই থানায় এই ধরনের শিশু বান্ধব কর্নার তৈরি করা হচ্ছে।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, কোনও বাচ্চা হারিয়ে গেলে তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসা হয়। অন্য কোনও দফতর নয়, থানার ভিতরেই প্রথমে ঠাঁই হয়। অভিভাবকের খোঁজ পাওয়া না গেলে তাকে হোমে পাঠানো হয়। অন্য দিকে, ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্ত ছেলে বা মেয়েকে (আঠেরো বছরের কম) গ্রেফতার করা হলে, তাকে থানায় এনে রাখা হয়। তার পরে জুভেনাইল আদালতে পাঠানো হয়। স্বভাবতই দুপুর বা বিকেলে গ্রেফতার করা হলে পরের দিন জুভেনাইল আদালতে তোলা হয়। ফলে, এক রাত থানাতেই কাটাতে হয় তাদের। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কখনও কিশোর-কিশোরীদের থানায় আনার দরকার হতে পারে। সমাজকল্যাণ দফতরের আধিকারিকদের বক্তব্য, অনেক ক্ষেত্রেই থানার ব্যাপার দেখে কিশোর মনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। তা যাতে না হয়, সেই কারণেই এই প্রকল্পের ভাবনা।
মনোবিদদের কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, এই ধরনের প্রচেষ্টায় সার্বিক সমস্যার সমাধান হবে না। তাঁদের বক্তব্য, কিশোর অপরাধীর মনে থানা-পুলিশের ধারণা বদলানো বা তাঁদের সুকুমার বৃত্তি ফোটাতে সংশ্লিষ্ট অফিসার থেকে বাড়ির লোকজনের মনোভাবের পরিবর্তন করা জরুরি। কেন না, একটি ছেলে বা মেয়ে যদি একটু বড়ও কোনও দোষ করে তা হলে পাড়া-পড়শি এমনকী বাড়ির লোকজনের চোখেও সে নিতান্ত ‘অপরাধী’ হিসেবেই গণ্য হয়। ‘পুলিশকাকু’ও তুই-তোকারি করে আর পাঁচটা চোরের মতোই তাদের সঙ্গে ব্যবহার করে থাকে। অপরাধী হলেও একটি ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে কী ভাবে ব্যবহার করতে হবে, তা নিয়ে পুলিশকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার।
মনোবিদ মোহিত রণদীপের কথায়, ‘‘মূল কথা হল প্রকৃত সংশোধনের পরিবেশ গড়তে হবে। সেটা থানা বা হোম সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এখনও কিন্তু সেই পরিবেশ গড়ে তোলা যায়নি।’’ মোহিতবাবুর বক্তব্য, কিশোর অভিযুক্তদের প্রকৃত সংশোধনের ব্যবস্থা করা দরকার। তবে তা আন্তরিকতার সঙ্গেই এটা করতে হবে। তাদের মধ্যে আত্মসম্মান বোধ বাড়াতে হবে। ছোট বা বড় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লে একজন শিশু নিজেকে অন্যদের থেকে ‘ছোট’ বা ‘হেয়’ হিসেবেই দেখে। এই ভাবনা তাদের মুক্তচিন্তা বা স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে আসার পথে অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে। তা ছাড়া হোমের পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া ছোটদের পক্ষে কষ্টকর হতে পারে। এ থেকে তাদের চরিত্রগত পরিবর্তনও হতে পারে।
এই ধরনের ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্তা দীপ পুরকায়স্থ বলেন, ‘‘শুধু থানায় শিশু বান্ধব কর্নার করলে কাজ শেষ হয়ে যায় না। পুলিশকর্মীদেরও ভূমিকা থাকে। শিশুবান্ধব কর্ণারে একটি ছেলে বা মেয়ে অনেক আরামদায়ক পরিবেশ পাবে। সেখানে পুলিশকাকুরা বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করলে সে অনেক খোলামনে কথা বলতে পারবে। সে ক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষেও কাজটি সহজ হবে।’’
হোম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘বিভিন্ন হোমে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করছে। সেখানে আবাসিকদের প্রয়োজনের কথা শোনা হচ্ছে। সব মিলিয়ে সরকারি প্রকল্প সত্যিই পুরোপুরি কার্যকর হলে ছোটদের পক্ষে খুবই ভাল হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy