কেউ গরম জল ছুড়ে দেন। কেউ মেরে চামড়া গুটিয়ে নেন। কারও হাতের ডান্ডা ভেঙে দেয় মাথা, পাঁজরের হাড়গোড়। দোলের দিন রাস্তার পাঁক তুলে সারা শরীরে লেপে দিয়ে কেউ ‘আনন্দ’ খোঁজেন। ল্যাজে পটকা বেঁধে উল্লাসে মাতে জনতা। শহরতলিতে এই ঘটনা নিত্যদিনের।
রাস্তার কুকুরের উপরে এমন অসংখ্য অত্যাচার প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলে। কলকাতায় ১৬টি কুকুর শাবককে পিটিয়ে মারার ঘটনা নেহাত সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে বলে এত তোলপাড়। কিন্তু অধিকাংশ সময়ে পথের কুকুরের উপরে অত্যাচার নিয়ে বিশেষ মুখ খোলেন না কেউ। আইনের হাত পৌঁছয় না অপরাধী পর্যন্ত।
যাঁরা এমন অত্যাচারে মজা পান কিংবা কুকুর পেটানোর পিছনে নিজেদের নিরাপত্তার অজুহাত খোঁজেন, তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, রাস্তায় এত কুকুর বাড়ছে বলেই না সমস্যা। কই কুকুরের বংশ নিয়ন্ত্রণের কথা তো কেউ ভাবে না!
যুক্তিটা একেবারে উ়ড়িয়েও দেওয়ার মতো নয়। মা ষষ্ঠীর দয়ায় পথের কুকুরের সংসারে বাড়বাড়ন্ত নেহাত কম নয়। কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে অবশ্য দেশে আইনকানুন আছে। কিন্তু তা মানছে কে!
বেঙ্গল মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্টে পথ কুকুদের নির্বীজকরণের (ভেসেকট্যামি) কথা স্পষ্ট বলা হয়েছে। শুধু হাওড়া, হুগলি, কলকাতা নয়। রাজ্যের প্রতিটি পুরসভার জন্যই এক নিয়ম। কিন্তু জানেন না অনেকেই। আবার অনেকে জানলেও খেয়াল করেন না। উত্তরপাড়া, কোন্নগর থেকে চন্দননগরের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর পর্যন্ত সকলেই জানিয়েছেন, এই খাতে সরকারি কোনও বরাদ্দ নেই।
উত্তরপাড়ার পুরপ্রধান দিলীপ যাদব, কোন্নগরের পুরপ্রধান বাপ্পাদিত্য চট্টোপাধ্যায় বা চন্দননগরের কমিশনার স্বপন কুণ্ডুদের বক্তব্য, এই খাতে অন্তত কোনও সরকারি টাকা আসে না। তবে সকলেই দাবি করেছেন, পথ কুকুর নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট দফতর রয়েছে। তাঁরা নানা পদক্ষেপও করে থাকেন।
সাধারণ মানুষ অবশ্য জানিয়েছেন, সরকারি কোনও পদক্ষেপ তাঁদের চোখে অন্তত পড়েনি। পরিবেশবিদ তথা আইন বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মানুষ তো জানেনই না কুকুর, পাখি-সহ কোনও জীবজন্তু বাড়িতে পুষলে পুরসভা বা পঞ্চায়েতে লাইসেন্স লাগে। সেটাই বিধি। কিন্তু পুরসভাও কি এখন সে বিধি ভুলতে বসেছে?’’
উত্তরপাড়ার বাসিন্দা সাহিত্যিক সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কলকাতার ঘটনা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। কিন্তু যে হারে পথ কুকুরের সংখ্যা বাড়ছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কিছু করা দরকার।’’ তাঁর দাবি, এটা একটা নাগরিক সমস্যা। বিএম অ্যাক্টে আইনি সংস্থান রয়েছে। কিন্তু কাউন্সিলরদের এ নিয়ে তেমন কিছু বলতে শোনা যায় না।
কুকুর নির্বীজকরণের জন্য তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ে না বলে জানিয়েছেন উত্তরপাড়ার বাসিন্দা আর এক সাংস্কৃতিক কর্মীও। বছর তিরিশের ওই যুবকের দাবি, ‘‘আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, রাস্তার কুকুর ধরে নিয়ে গিয়ে নির্বীজকরণের পরে ফের তাদের ছেড়ে দেওয়া হত। গত কুড়ি বছরে তেমন দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’’
উলুবেড়িয়া পুরসভার কর্মীরা আবার মানতেই চাননি, রাস্তার কুকুর নিয়ে তাঁদের কিছু করণীয় আছে বলে। মহকুমা হাসপাতালের মাঠ, বিভিন্ন হোটেল, নার্সিংহোমের সামনে বেড়েছে কুকুরের দৌরাত্ম্য। সন্ধ্যার পরে অনেক সময়েই মানুষ হাসপাতালের সামনে দিয়ে যেতে ভয় পান— কুকুর তাড়া করে। উপ পুরপ্রধান আব্বাসুদ্দিন খান বলেন, ‘‘পথ কুকুরদের সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। কিন্তু তাদের নিয়ে কী করা হবে, তা নিয়ে কোনও পরিকল্পনা নেই পুরসভার।’’ কলকাতার ঘটনার পরে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, ‘‘আগামী বোর্ড মিটিংয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব।’’
হাওড়া জেলার পঞ্চায়েত এলাকাগুলিতেও পথ কুকুরদের নিয়ে আলাদা কোনও চিন্তাভাবনা নেই বলে স্বীকার করলেন জেলা প্রশাসনের এক কর্তা। তাঁর কথায়, ‘‘অনেককে কুকুরে কামড়ালে শিবির করে জলাতঙ্কের প্রতিষেধক দেওয়া হয়। কিন্তু কুকুরদের নির্বীজকরণ নিয়ে কোনও পরিকল্পনা পঞ্চায়েত স্তরে নেই।’’ আর এই পরিস্থিতি ডেকে এনেছে মানুষ-পশুর সংঘাতের পরিস্থিতি। কুকুর যেমন কামড়াচ্ছে, ছেড়ে কথা বলছে না এক শ্রেণির মানুষ। সমস্যা তাদের নিয়েই।
উলুবেড়িয়ার এক প্রবীণ নাগরিকের কথায়, ‘‘এত দিন শুনে এসেছি, কুকুর হইতে সাবধান। এখন তো মানুষের থেকেও কুকুরদের সাবধান থাকার সময় এসেছে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy