Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন ভুলে লড়ছেন ওঁরা

ওঁরা সকলেই এসেছেন ভিন্ন পরিবার থেকে। তবে এক জায়গায় বড়ই মিল তাঁদের। শ্বশুরবাড়ির লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁরা ঘর ছেড়েছেন। জীবনের লড়াইয়ে হেরে না গিয়ে আজ প্রত্যেকেই স্বনির্ভর।

প্রকাশ পাল
শ্রীরামপুর শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৭ ০১:৩৬
Share: Save:

ওঁরা সকলেই এসেছেন ভিন্ন পরিবার থেকে। তবে এক জায়গায় বড়ই মিল তাঁদের। শ্বশুরবাড়ির লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁরা ঘর ছেড়েছেন। জীবনের লড়াইয়ে হেরে না গিয়ে আজ প্রত্যেকেই স্বনির্ভর।

সুমনার স্বামী তাঁকে বিক্রি করার ফন্দি এঁটেছিল। সুমিতার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাঁকে চুলের মুঠি ধরে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল। অন্য নারীর সঙ্গে স্বামীর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি মিতালি। প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। বদলে কপালে জুটত মার। রোজকার সেই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মিতালি বেরিয়ে এসেছিলেন শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে।

নিশ্চিন্ত আশ্রয় জেনে যে পরিবারে বাবা-মা তাঁদের বিয়ে দিয়েছিলেন, সেই আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলেও সুমনা, সুমিতা দমে যাননি! স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষা নিয়ে খুঁজে নিয়েছেন বাঁচতে শেখার রসদ। সুমনা, সুমিতাদের মতো অনেকেই পারিবারিক বা সামাজিক লাঞ্ছ‌নার শিকার হয়েও হেরে যান‌নি। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শপথ নিয়েছেন। নিজেদের রোজগারে ছেলেমেয়েকে মানুষ করছেন তাঁরা। ওঁদের কারও বাড়ি হুগলিতে, কারও উত্তর ২৪ পরগনা বা দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। কেউ থাকেন মেদিনীপুরে।

ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইতে এঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে শ্রীরামপুরের শ্রমজীবী হাসপাতাল।

উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটিতে থাকতেন জ্যোৎস্না ধাড়া। বিএ পাশ। খোখো এবং কবাডিতে বেশ নামডাক ছিল। কয়েক বছর আগে এলাকারই এক যুবককে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন। মহিলার কথায়, ‘‘ব্যবসার কথা বলে স্বামী বাপের বাড়ি থেকে টাকা-গয়না চাইতেন। এনে না দিলেই চলত মারধর। আস‌লে স্বামীর স্বভাব-চরিত্র যে ভাল ছিল না, আগে বুঝতে পারিনি। অত্যাচার আর সহ্য করতে পারছিলাম না।’’

এই পরিস্থিতিতে এক সময় কাজের খোঁজে বের হন ওই মহিলা। পরিচয় হয় এক মহিলার সঙ্গে। পরে বুঝতে পারেন, ওই মহিলা তাঁকে বিক্রির ছক কষছেন। এর পরে শ্রীরামপুরের পিয়ারাপুরে একটি গুমটিতে খাবার বিক্রি শুরু করেন। কিন্তু দিল্লি রোডের ধারে একা মহিলার নিরাপত্তার অভাব ছিল যথেষ্ট। বছর খানেক আগে শ্রমজীবী হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত হন স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে। জ্যোৎস্নার কথায়, ‘‘দুই ছেলেমেয়ে নৈহাটিতে মায়ের কাছে থাকে। মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। নাচ-গান শেখে। ছেলে পড়ে প্রথম শ্রেণিতে। তবলা শেখে। খুব বেশি রোজগার করি না। তবে একটাই সান্ত্বনা, আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে পারছি। ছেলেমেয়ে দু’টোকে মানুষ করাই এখন আমার চ্যালেঞ্জ।’’

সুমনার বিয়ে হয়েছিল শেওড়াফুলিতে। যৌনপল্লিতে যাতায়াত ছিল স্বামীর। বছর দশেক আগে এক নেপালি মহিলার মাধ্যমে স্বামী তাঁকে ভিন দেশে পাচারের ছক কষেছিলেন। জানাজানি হয়ে যাওয়ায় এখন তাঁর ঠাঁই শ্রমজীবী হাসপাতাল। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। মেয়ের বিয়েও দিয়েছেন।

ঘুরে দাঁড়ানোর এই লড়াইয়ে আর এক শরিক শ্রমজীবী হাসপাতালের ডায়ালিসিস বিভাগের কর্মী মিতালিও। স্বামীর সঙ্গে অন্য মহিলার সম্পর্কের প্রতিবাদ করায় জুটেছিল মার, গঞ্জনা। সহ্য না করে এক কাপড়ে স্বামীর ঘর ছেড়েছিলেন। বর্তমানে শ্রমজীবী হাসপাতালের কর্মী মিতালি বলেন, ‘‘এখন মানসিক ভাবে অনেক ভাল আছি।’’

মিতালির মতোই জীবনকাহিনি সুমিতার। শ্বশুরবাড়ি থেকে ঘাড়ধাক্কা খেতে হয়েছিল স্বামীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের প্রতিবাদ করা। দমে যাননি। এখন তিনি শ্রমজীবী হাসপাতালের ঝাড়ুদার। মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। বললেন, ‘‘শ্বশুরবাড়িতে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা যেন মেয়ের না হয়। সে ভাবেই ওকে গড়ে তোলার স্বপ্ন রয়েছে।’’

মানসিক ভারসাম্যহীন স্বামী প্রায়ই মারধর করত। বছর কয়েক আগে দুই মেয়ের হাত ধরে বাপের বাড়িতে চলে এসেছিলেন। শ্রমজীবী হাসপাতালে আয়া তহমিনার কথায়, ‘‘মেয়েদু’টোকে মানুষ করতেই হবে। আমার মতো দশা ওদের যাতে না হয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।’’

এমন সাহসী, লড়াকু মহিলাদের নিয়ে কী বলছেন হাসপাতালের কর্তা গৌতম সরকার।

তাঁর কথায়, ‘‘ওঁরা প্রত্যেকে নিজেদের মতো করে লড়াই করছেন। আমরা ওঁদের পাশে আছি, থাকব।’’ (মহিলাদের সকলের নাম পরিবর্তিত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Assault Women
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE