Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

হেস্টিংস খুলুক, শ্রমিকের সঙ্গে প্রার্থনা ব্যবসায়ীদেরও

সোমবার ওই চটকলে ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’-এর বিজ্ঞপ্তি ঝুলেছে। পাঁচ হাজার শ্রমিক বেকায়দায় পড়েছেন। সঙ্গে সউদের মতো কয়েকশো মানুষের ব্যবসাতেও যেন অলিখিত ভাবে ঝুলেছে সেই বিজ্ঞপ্তি!

দুর্দশা: দুশ্চিন্তা কাটছে না শ্রমিক পরিবারের। নিজস্ব চিত্র

দুর্দশা: দুশ্চিন্তা কাটছে না শ্রমিক পরিবারের। নিজস্ব চিত্র

প্রকাশ পাল
রিষড়া শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০৪
Share: Save:

মঙ্গলবার দুপুর ২টো। জিটি রোডের ধারে চায়ের গুমটিতে গালে হাত দিয়ে বসে মহম্মদ সউদ। কয়েক পা দূরেই হেস্টিংস চটকলের গেট। অন্য দিন এই সময়টায় শ’য়ে শ’য়ে মানুষ দল বেঁধে ওই গেট দিয়ে ঢোকেন। আর এক দল বেরিয়ে আসেন। সউদের গুমটি ঘিরে থাকা চারটে বেঞ্চে বসে চায়ের ভাড়ে চুমুক দেন‌ অনেকে। এ দিন জায়গাটা বিলকুল ফাঁকা।

সউদ জানালেন, এ দিনও কাকভোরে দোকান খুলেছেন। অন্য দিন কয়েকশো ভাড় চা বিক্রি হয়। এ দিন তা মেরেকেটে ৬০-৭০ ভাড়।

সোমবার ওই চটকলে ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’-এর বিজ্ঞপ্তি ঝুলেছে। পাঁচ হাজার শ্রমিক বেকায়দায় পড়েছেন। সঙ্গে সউদের মতো কয়েকশো মানুষের ব্যবসাতেও যেন অলিখিত ভাবে ঝুলেছে সেই বিজ্ঞপ্তি! মিল বন্ধের প্রভাব পড়েছে স্থানীয় অর্থনীতিতে। ওই চা বিক্রেতার কথায়, ‘‘তিন ছেলে অন্যত্র থাকে। স্বামী-স্ত্রী স্কুলপড়ুয়া দুই ছেলেকে নিয়ে থাকি। মিল বন্ধ হওয়ায় সংসার চাল‌ানো মুশকিল হবে।’’

পাশেই আলু বেচেন প্রদীপ দাস। বিক্রিবাটা কেমন হল? প্রশ্ন শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে টেনে প্রদীপ বলেন, ‘‘মিল বন্ধ হলে যেমন চলার কথা! আমরা শ্রমিক নই, কিন্তু আমাদের সংসারও মিলের উপরে নির্ভর করে।’’ নালিকুলের বাসিন্দা প্রদীপবাবু জানান, কেনা দামেও আলু বিক্রি করতে পারছেন না। মিলের পাশে একজন দৈনিক এক প্যাকেট (৫০ কিলোগ্রাম) আলু কেনেন। মঙ্গলবার আসেননি। খবর দিয়েছেন, মিল না খোলা পর্যন্ত নেবেন না।

আনাজ বিক্রেতা মহম্মদ মুস্তাফা, মাছ বিক্রেতা মহম্মদ সালাউদ্দিন, মুদি দোকানি অলোক দাঁ— সকলেই একবাক্যে জানান, বিক্রি কমেছে। সালাউদ্দিনের কথায়, ‘‘আজ লোকসান খেয়েছি। কাল থেকে অল্প মাছ কিনব।’’ বিক্রেতাদের অনেকেই জানান, দুর্গাপুজোর পর থেকেই ওই চটকলে সমস্যা চলছে। শ্রমিকদের কথা ভেবে ধার বাকিতে আনাজ দিচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু এ বার একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ধারের টাকাও মিলবে কিনা জানা নেই।

মিল বন্ধের জেরে দুশ্চিন্তায় শ্রমিক মহল্লা। শ্রমিক আবাসনের ১০ ফুট বাই ৯ ফুট এক কামরার ঘরে স্ত্রী এবং তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকেন হেস্টিংসের তাঁত বিভাগের শ্রমিক অনিল প্রসাদ। এক মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে এ বার। আর এক মেয়ে আর ছেলে মাধ্যমিক। অনিল বলছিলেন, ‘‘ছেলেমেয়ের মাইনে দিতেই মাসে ৩ হাজার টাকা লাগে। চিন্তায় পড়ে গেলাম।’’ স্ত্রী রিতা জানান, ডাল আর ভাত ছাড়া কিছু রান্না হয়নি।

প্রৌঢ় কেবল দাসের দুই ছেলে এবং স্ত্রী উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে থাকেন। তাঁদের জন্য টাকা পাঠান কেবল। তিনি বলেন, ‘‘মিলের মালিক বলছেন, টাকা নেই। এই বয়সে কোথায় কাজ পাব?’’ কয়েক মাস পরে কৃষ্ণ প্রসাদের ছেলের বিয়ে। লজ, গাড়ি, বাজনার দল ভাড়া করা হয়ে গিয়েছে। মিল বন্ধ হওয়ায় দুশ্চিন্তায় তিনিও। ড্রয়িং বিভাগের শ্রমিক সিদ্ধার্থ প্রসাদের কথায়, ‘‘কাজের আশায় অন্য মিলে হত্যে দিতে হবে।’’

মিলের শ্রমিক-নেতা তথা রিষড়া পুরসভার কাউন্সিলর সাকির আলি বলেন, ‘‘মিল বন্ধ হওয়ায় গোটা এলাকায় প্রভাব পড়েছে। শ্রমিকদের মতোই স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও বিপাকে। মিল খুললেই ফের বাজার চাঙ্গা হবে। মিল খো‌লার দাবি জানাচ্ছি আমরা।’’

আবাসনের পাশে টুকটাক জিনিস বিক্রি করেন বাবলু রায়। তাঁর কথায়, ‘‘দুর্গাপুজোর পর থেকেই অবস্থা খারাপ হচ্ছিল। দোকান কোনও রকমে চলছে।’’ মিলের গেটের পাশে কাপড়ের দোকান শঙ্কর বিজয় সাউয়ের। বলছিলেন‌, ‘‘ছ’ঘণ্টাতে একটা রুমাল পর্যন্ত বিক্রি হয়নি। এই মিলের জন্যই আমাদের সংসার চলে। এখন মিলের কারণেই দুর্দশা। শুধু শ্রমিকরা নন, আমরাও চাইছি দ্রুত মিল খুলুক।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hastings Jute Mill
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE