Advertisement
১৯ মে ২০২৪

ঘড়িবাড়ি মাঠে মুক্তমঞ্চই চায় সঙ্গীত-নাটক-সিনেমার এই শহর

ছয়ের দশকের গোড়ার কথা। ছোট্ট কিশোর আমজাদ বাবা উস্তাদ হাফিজ আলি খানের সরোদ বয়ে এনেছেন উত্তরপাড়া সঙ্গীতচক্রের সম্মেলনে। ছোট্ট আমজাদের অবশ্য তখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে সুর-সাধনা। নিয়মনিষ্ঠ শিল্পী বাবা হাফিজ সংস্থার প্রবীণদের থেকে অনুমতি চান ছেলে তাঁর সঙ্গে যন্ত্র নিয়ে বসবে কি না। এ বার অবাক হবার পালা শ্রোতাদের।

সমতটের নাট্যমেলার উদ্বোধনে অভিনেতা এ কে হাঙ্গল, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।

সমতটের নাট্যমেলার উদ্বোধনে অভিনেতা এ কে হাঙ্গল, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
উত্তরপাড়া শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৪ ০১:১৯
Share: Save:

ছয়ের দশকের গোড়ার কথা।

ছোট্ট কিশোর আমজাদ বাবা উস্তাদ হাফিজ আলি খানের সরোদ বয়ে এনেছেন উত্তরপাড়া সঙ্গীতচক্রের সম্মেলনে। ছোট্ট আমজাদের অবশ্য তখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে সুর-সাধনা। নিয়মনিষ্ঠ শিল্পী বাবা হাফিজ সংস্থার প্রবীণদের থেকে অনুমতি চান ছেলে তাঁর সঙ্গে যন্ত্র নিয়ে বসবে কি না। এ বার অবাক হবার পালা শ্রোতাদের। সঙ্গীতচক্রের সদস্য রমেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে এও শোনা গেল, ১৫ বছর বয়সে আমজাদের জীবনে সেটাই ছিল প্রথম মঞ্চ উপস্থাপনা। এমনকী মিষ্টি খেতে উদ্যোক্তাদের তরফে আমজাদকে দেওয়া টাকা তিনি হাতে নেওয়ায় বাবা হাফিজ ছেলের উপর রুষ্ট হয়েছিলেন। পরে অনেক বুঝিয়ে তাঁকে শান্ত করেন সংস্থার প্রবীণ সদস্যরা। বাবা হাফিজ বাচ্চা ছেলের হাতে টাকা নেওয়ার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। উত্তরপাড়া সঙ্গীতচক্রের সম্মেলনের এমন হাজারো স্মৃতি মুখে মুখে ফেরে সঙ্গীত রসিকদের।

সংস্কৃতিচর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতায় বালির উত্তরে গঙ্গাতীরের এই ছোটো জনপদ বরাবরই খুবই উর্বরা। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, নাটক, শিল্প-সংস্কৃতির ধাত্রীভূমি এই শহর। বাংলার সংস্কৃতি জগতে এমন নক্ষত্র কমই আছেন যাঁর ছায়া সংস্কৃতির এই শহরে পড়েনি। বস্তুত বারুদের গন্ধ মাখা সত্তর দশকেও উত্তাল রাজনীতির পাশাপাশি এই শহর সংস্কৃতি জগতে নিজের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছে।

মৃণাল সেন, অনুপ কুমার, ধীরেন দাস, গীতা সেনের মতো দিকপাল মানুষ এক সময় উত্তরপাড়ার সংস্কৃতি চর্চার পুরোধা ছিলেন। সেই সময় উত্তরপাড়ার নাট্যচক্র ছিল শহরের সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র। ১৯৫০ সালে নাট্যচক্রের প্রযোজনায় ‘মশাল’ নাটকটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রখ্যাত নাট্যকার দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাঙ্গার পটভূমিতে লেখা সেই নাটক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। হুগলির গন্ডি ছাড়িয়ে সে সময় রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় অভিনীত হয়েছিল সেই প্রযোজনা। নাট্যচক্রের সফল প্রযোজনাগুলির ক্ষেত্রে সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন অসীমানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, রুণু দাশগুপ্ত-বন্দ্যোপাধ্যায়, গুরুপদ দে-র মতো নাট্যকর্মী পরিচালকেরা।

আজ, বহু বছর পরেও নাট্যচর্চার সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি এই শহরে। তবে সময় পরিবর্তনের সঙ্গে অবধারিত বদল ঘটেছে নাট্যচর্চার বিষয়ে। সামাজিক পটভূমি, ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন নাটকের উপাদান হিসেবে উঠে এসেছে। যার পতাকা বয়ে চলেছে বর্তমানে আমরা, ইউনিট থিয়েটার, সমতট, মৃত্তিকা, উত্তরায়ণ, রূপকল্প-সহ আরও নানা নাট্যদল নিয়মিত নাট্যচর্চার মাধ্যমে। আমরা নাট্য সংস্থার নো-এন্ট্রি, ইউনিটের হচ্ছে-টা কী? সীমন্তক-এর প্রযোজনায় অমিতাভ ঘোষের লেখা দুঃখসুখের গল্প, দূরত্ব, তিমিরবরণ রায়ের পরিচালনায় শিল্পক গোষ্ঠীর নাটক, কথা নাট্য সংস্থা প্রযোজিত তপন দাসের লেখা সমান্তরাল নাটক জনপ্রিয়তা পায়। উত্তরপাড়ার নাট্যচর্চায় অরুণ চক্রবর্তী, আশিস চট্টোপাধ্যায়, অলকেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্কর চক্রবর্তী, অসীম ভট্টাচার্যের উপস্থিতি অনেক প্রযোজনাকেই সমৃদ্ধ করেছে।

নাটকের পাশাপাশি উত্তরপাড়ার সঙ্গীতচর্চার নেপথ্যেও কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ধারাবাহিকতা থেকে গিয়েছে। যার সর্বাগ্রে রয়েছে উত্তরপাড়া সঙ্গীতচক্র। এক সময় সঙ্গীতচর্চায় কলকাতার বিভিন্ন শস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্মেলনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সেই সব সম্মেলনে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের পাশপাশি নতুন প্রজন্মের শিল্পীরাও সুযোগ পেতেন নিজেদের মেলে ধরার। কলকাতায় ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলনের পাশাপাশি জেলাগুলিতেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসত। শ্রীরামপুর সঙ্গীত সমাজ ছিল তেমনই একটি আসর। কিন্তু সময়ের দৌড়ে ক্রমশ হারিয়ে গিয়েছে সে সব আসর। যেগুলি এখনও স্বমহিমায় টিকে রয়েছে উত্তরপাড়ার সঙ্গীতচক্র তার অন্যতম। ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত নিয়মিত ভাবে উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে এঁদের উদ্যোগে আয়োজিত হয়ে চলেছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্মেলন। সংগঠনে যেমন একশ্রেণির সঙ্গীতনিষ্ঠ প্রবীণ সদস্য রয়েছেন। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের ছেলেরাও এগিয়ে এসেছেন এই ধারাবাহিকতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এই দু’য়ের যোগফলেই আজও সঙ্গীতরসিকদের কাছে এই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অসীম। সঙ্গীত সম্মেলনের পাশাপাশি সারা বছর ধরেই নাচ, গান-সহ নানা বাদ্যযন্ত্রের তালিম দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। সংস্থার প্রবীণ সদস্য ইন্দ্রনাথ পাল মনে করিয়ে দেন, “অনেক সঙ্গীত সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে। কিন্তু আমাদের সংগঠন তার উজ্বল ব্যতিক্রম।”

উত্তরপাড়ার সঙ্গীত সম্মেলন ঘিরে বিখ্যাত শিল্পীদের নানা অভিজ্ঞতাও শহরের সঙ্গীতরসিকদের মুখে মুখে ফেরে। সে সব গল্পও রীতিমত রোমাঞ্চকর। অসুস্থ অশক্ত বড়ে গোলাম আলি খাঁ-সাহেবকে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর রমা চৌধুরী সাম্মানিক ডি লিট প্রদান করেন সঙ্গীতচক্রের মঞ্চ থেকেই। বড়দের মুখে শোনা সেই সময়ের নানা গল্পের সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেল সংস্থার এই প্রজন্মের সদস্য রঞ্জন সেনগুপ্তর কাছে।

সঙ্গীত, নাট্যচর্চার পাশাপাশি উত্তরপাড়া ছিল ফিল্ম চর্চারও অন্যতম ক্ষেত্র। উত্তরপাড়া সিনে ক্লাব এক সময় শহরের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভাল ফিল্ম দেখার আগ্রহ তৈরি করেছিল। এ সবের সঙ্গেই উত্তরপাড়ার অন্যতম সংস্কৃতি মেলা। তা নাটকেরই হোক বা বইয়ের। শীতের অতিথি হয়ে শহরে ইতিমধ্যেই নাট্যমেলার প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছে। ২০ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে নাট্যমেলা। তার আগেই শেষ হচ্ছে বইমেলা। প্রায় দেড় দশক যার আয়োজন করে আসছে দিলীপ যাদবের সংস্থা সমন্বয়।

তবে সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থান উত্তরপাড়ার মানুষের একটাই খেদ, শহরের সংস্কৃতিচর্চার ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের হলেও অভাব রয়েছে ভাল প্রেক্ষাগৃহের। নানা সময়ে গণভবন সংস্কার করে উন্নীত করার চেষ্টা হলেও তা খুব একটা কাজে আসেনি। উত্তরপাড়ার সমতট নাট্য সংস্থার কর্ণধার বাসুদেব হুই-এর আক্ষেপ, “ঘড়িবাড়ি ভেঙে আবাসন হয়েছে। বাড়ছে শহরের পরিধি। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে একটি ভাল মুক্তমঞ্চের অভাব আজও অনুভব করেন শহরের শিল্পী থেকে সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। ঘড়িবাড়ি মাঠে মুক্তমঞ্চের দাবি তুলেছেন শহরবাসী। বর্তমান সরকার সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নানা পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। এদিকে নজর দিলে উত্তরপাড়ার মানুষ উপকৃত হবেন।”

মুক্তমঞ্চ গড়ায় রাজ্য সরকারের নজর পড়বে কি না, তা সময় বলবে। কিন্তু শহরের সংস্কৃতিপ্রমী মানুষের এমন দাবি বুঝিয়ে দেয় উত্তরপাড়া আজও আছে উত্তরপাড়াতেই।

ছবি: দীপঙ্কর দে।

কেমন লাগছে আমার শহর? আপনার নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-কাকদ্বীপ’।
অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর’, হাওড়া ও হুগলি বিভাগ, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১।
ফেসবুকেও প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন। www.facebook.com/anadabazar.abp

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE