Advertisement
১১ মে ২০২৪

বরাত অমিল, অভাব মূলধনেরও ধুঁকছে হাওড়ার ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প

একে কয়েক বছরে জেলায় সে ভাবে কোনও বড় শিল্প গড়ে ওঠেনি। তার উপরে যে সব শিল্প-কারখানা রয়েছে, তা থেকেও সে ভাবে বরাত মিলছে না। ফলে, মুখ থুবড়ে পড়েছে হাওড়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বা যন্ত্রাংশ তৈরি শিল্প। তাঁদের ভবিষ্যৎ ভেবে দিশাহারা ওই সব শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকেরা। শিল্পের পুনরুজ্জীবনের জন্য তাঁরা সরকারি সাহায্যের দাবিও তুলেছেন। জেলার ছোট বা মাঝারি শিল্পগুলির পুনরুজ্জীবনের জন্য জেলা চেম্বার অব কমার্সের পক্ষ থেকে জগৎবল্লভপুরে একটি ক্লাস্টার গড়া হচ্ছে।

আমতার বেতাইয়ে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা। ছবি: সুব্রত জানা।

আমতার বেতাইয়ে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা। ছবি: সুব্রত জানা।

মনিরুল ইসলাম
আমতা শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৪ ০২:১২
Share: Save:

একে কয়েক বছরে জেলায় সে ভাবে কোনও বড় শিল্প গড়ে ওঠেনি। তার উপরে যে সব শিল্প-কারখানা রয়েছে, তা থেকেও সে ভাবে বরাত মিলছে না। ফলে, মুখ থুবড়ে পড়েছে হাওড়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বা যন্ত্রাংশ তৈরি শিল্প। তাঁদের ভবিষ্যৎ ভেবে দিশাহারা ওই সব শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকেরা। শিল্পের পুনরুজ্জীবনের জন্য তাঁরা সরকারি সাহায্যের দাবিও তুলেছেন।

জেলার ছোট বা মাঝারি শিল্পগুলির পুনরুজ্জীবনের জন্য জেলা চেম্বার অব কমার্সের পক্ষ থেকে জগৎবল্লভপুরে একটি ক্লাস্টার গড়া হচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে তা চালু হওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে জেলার সব ছোট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের জায়গা হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের। জেলা চেম্বার অব কমার্সের চেয়ারম্যান শঙ্কর সান্যাল জানান, ওই ক্লাস্টারে জেলার ছোট শিল্পগুলিকে এক ছাদের তলায় এনে পরিকাঠামোগত সুবিধা, উন্নত প্রয়ুক্তি-সহ বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হবে। তিনি স্বীকার করেছেন, “ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য রাজ্যে বড় শিল্প দরকার। তবেই অনুসারী শিল্পগুলির পুনরুজ্জীবন সম্ভব। সেই সঙ্গে প্রয়োজন উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ।”

এক সময়ে হাওড়ার ‘শিল্পনগরী’ হিসেবে প্রসিদ্ধি ছিল। চটকল তো বটেই, বস্ত্রশিল্প, রেলের কারখানা-সহ নানা ধরনের শিল্প গড়ে উঠেছিল এখানে। আর এই সব বড় শিল্পে যন্ত্রাংশ সরবরাহ করার জন্য হাওড়া শহর এবং গ্রামীণ এলাকার বহু জায়গায় গড়ে উঠেছিল ছোট কারখানা বা ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প। এ জন্য হাওড়াকে ‘শেফিল্ড অব ইন্ডিয়া’ও বলা হত। মূলত লেদ কারখানা থেকেই ওই সব ছোটখাটো যন্ত্রাংশ তৈরি হত। হাওড়া শহরের বেলিলিয়াস রোড, বাঁকড়া, মধ্য হাওড়া-সহ বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি বাড়ি লেদ কারখানা গড়ে ওঠে। গ্রামীণ এলাকার মধ্যে শুধু আমতার বেতাই এবং জগৎবল্লভপুরের বড়গাছিয়াতেও তৈরি হতে থাকে ওই কারখানা। ওই দুই গ্রামীণ এলাকায় প্রায় ৩০০টি লেদ কারখানা গড়ে ওঠে। বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়। ওই সব কারখানায় তৈরি যন্ত্রাংশ পাটশিল্প, বস্ত্রশিল্প, চামড়া শিল্প, অটোমোবাইল শিল্প-সহ বহু শিল্পে ব্যবহৃত হত। জেলার গণ্ডি ছাড়িয়ে রাজ্যের অন্যত্র তো বটেই, ওই যন্ত্রাংশ যেত ভিন্ রাজ্যেও।

সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, ২০১০-১১ সাল পর্যন্ত জেলায় ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে রমরমা ছিল। খরচ বাদ দিয়ে মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা লাভ থাকত। এক-একটি কারখানায় ১০-১৫ জন শ্রমিক কাজ করতেন। বরাত প্রায় ৬০ শতাংশ কমে যাওয়ায় এখন সেই লাভের পরিমাণ মাসে মাত্র পাঁচ-ছ’হাজারে নেমে গিয়েছে। ফলে, শ্রমিকের সংখ্যাও কমছে। চটকল থেকে তো বটেই, অন্য বড় শিল্প থেকেও সে ভাবে বরাত মিলছে না। এই পরিস্থিতিতে জগৎবল্লভপুরের বেশ কিছু ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানার মালিকেরা ভিন্ রাজ্যে যন্ত্রাংশ পাঠানোরও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সফল হননি।

“টাকার অভাবে পুরনো আমলের যন্ত্রেই যন্ত্রাংশ তৈরি করতে হচ্ছে।
কোনও আধুনিক প্রযুক্তি বা ডিজাইন ব্যবহার করতে পারছি না।
ফলে, ব্যবসা মার খাচ্ছে।” —মনোজ হাজরা, কারখানার মালিক

এই পরিস্থিতির জন্য মূলধনের অভাবকেও তাঁরা দায়ী করেছেন। যেমন, মনোজ হাজরা নামে এক ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানার কর্ণধার বলেন, “টাকার অভাবে পুরনো যন্ত্রেই যন্ত্রাংশ তৈরি করতে হচ্ছে। কোনও আধুনিক প্রযুক্তি বা ডিজাইন ব্যবহার করতে পারছি না। ফলে, ব্যবসা মার খাচ্ছে।” উদাহরণ দিয়ে তিনি জানান, বস্ত্রশিল্পে কাজে লাগে বারটেক ক্যাম্প’ নামে এক ধরনের যন্ত্রাংশ। এটা হাওড়ার লেদ কারখানায় তৈরি করতে খরচ পড়ে ২৫০-৩০০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি ওই যন্ত্রাংশ বাজারে মাত্র ৮০ টাকায় মেলে।

প্রশাসন সূত্রে খবর, গত কয়েক বছরে শুধু আমতা এবং জগৎবল্লভপুরে অন্তত ১৫টি ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দিনপ্রতি ১২০ টাকা মজুরির কাজ ছেড়ে বেশ কিছু কারখানার শ্রমিক দিনমজুরি, ইঞ্জিনভ্যান চালানোর মতো পেশা বেছে নিয়েছেন। যেমন, বেতাইয়ের একটি কারখানার শ্রমিক সুদাম পাল বছর খানেক ধরে মোটরভ্যান চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, “সংসারের খরচ যে ভাবে বাড়ছে, তাতে কারখানায় কাজ করে সেই খরচ উঠছিল না। তাই এখন ভ্যান চালাই। কোনও মতে সংসার চলে যায়।” আর এক কারখানার শ্রমিক মনোজ হাজরা বলেন, “১২০ টাকা মজুরিতে আর চলছে না। বিকল্প ব্যবস্থা দেখতে হবে।”

জেলা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দফতরের অধিকর্তা অশোক সিংহরায় অবশ্য জগৎবল্লভপুরে নির্মীয়মাণ ক্লাস্টারটির মাধ্যমে ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পগুলিকে চাঙ্গা করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন। মন্ত্রী অরূপ রায়েরও আশ্বাস, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প পুনরুজ্জীবনের চিন্তাভাবনা চলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

southbengal amta manirul islam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE