এই কচ্ছপই বিক্রি হচ্ছে মধ্যমগ্রামের বাজারে। — নিজস্ব চিত্র
গোলমাল হ্যায় ভাই সব গোলমাল হ্যায়।
যদিও এ গল্পে কোনও গোলমাল নেই, কিন্তু ‘গোল মাল’ আছে বিলক্ষণ।
এই ‘গোল মালের’ সন্ধান পেতে আপনাকে যেতে হবে মধ্যমগ্রাম স্টেশনের কাছে বসুনগর বাজারে, জনৈক খোকনদার কাছে। ভরসন্ধে বেলা শহরতলির জমজমাট বাজারে মাছের পসরা সাজিয়ে বসেন তিনি। ট্যাংরা, চিতল, পাবদা, গলদার রুপোলি স্তূপে মাথা উঁচু করে আছে বিশাল এক আঁশ-বঁটি। খদ্দেরের ভিড়ে নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই তাঁর। সমানে চলছে দরদাম, কাটাকুটি, কেনাকাটা।
এর মধ্যেই একটু ফাঁক বুঝে, খোকনদার কাছে গিয়ে, নিচু স্বরে, অনেকটা যেন লুকিয়ে চকলেট বোমা কেনার মতো সতর্কতা নিয়ে, আলতো করে জিজ্ঞেস করতে হবে, ‘‘গোল মাল আছে?’’ হাসবেন খোকনদা। তার পর খোকনদার চোখের ইশারায় এক কর্মী আপনাকে নিয়ে যাবে মাছে ভর্তি সিমেন্টের স্ল্যাবটার পেছন দিকে। ছোট ছোট গামলায় জল ভরা রয়েছে সেখানে। আর সেই জলে খেলে বেড়াচ্ছে ‘গোল মাল’-এর দল।
এ বার পালা পছন্দ করে দর-দস্তুর করার। সে পর্ব মিটে গেলে, ওজন-যন্ত্র হয়ে সেই ‘গোল মাল’কে মাছের বঁটিতেই কাটবেন খোকনদা। যত্ন করে খোলস ছাড়িয়ে, পরিষ্কার করে, মাপ-মতো টুকরো করে, প্যাকেটে বেঁধে তুলে দেবেন ক্রেতার হাতে। ব্যস, এ ভাবেই দেদার বিকোচ্ছে ‘গোল মাল’।
কী এই ‘গোল মাল’?
বৈজ্ঞানিক ভাষায় এই ‘গোল মালের’ নাম, লিসেমিস পাংটাটা পাংটাটা। ধাঁধা মনে হচ্ছে? না, এত জটিল কিছু নয়। সহজ ভাষায়, কচ্ছপ। আর বিক্রেতার সাংকেতিক ভাষায় ‘গোল মাল’। এদের পসরা নিয়ে মধ্যমগ্রামের বসুনগর বাজারে জমিয়ে ব্যবসা করছেন খোকনদা। আগে থেকে একটা ফোন করে রাখলে ভাল, ‘মাল’ চলে আসবে চাহিদামতো। ফোন না-করলেও মাছ কেনার মতো করেই মিলতে পারে বাজারে গিয়ে, তবে তা নির্ভর করছে জোগানের ওপর। জোগান না-থাকলে কিছু দিন অপেক্ষা করতে হতে পারে।
এখন যেমন, শীত পড়তে শুরু করবে করবে। আর ‘গোল মাল’-এর জোগানও বাড়তে শুরু করেছে। এখন ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা প্রতি কেজি দরে বিকোচ্ছে তারা। আরও একটু শীত বাড়লে বাড়বে জোগানও। প্রতি কেজির দাম নেমে আসবে ৩০০-৪০০ টাকা পর্যন্ত। শীতেই বাড়ে কচ্ছপের সংখ্যা। জল পেরিয়ে ডাঙায় এসে ধরা দেয় তারা। আবার মরসুম পেরিয়ে গেলে, ‘মাল’ কম আসে। তখন দাম ওঠে হাজার টাকা থেকে বারোশো টাকা প্রতি কেজি।
প্রাণী বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন যে প্রজাতির কচ্ছপটি বিক্রি হচ্ছে মধ্যমগ্রামের বাজারে, তা বিপন্ন প্রজাতির অন্তর্গত। হত্যা করা বা বিক্রি করা নিষিদ্ধ। বস্তুত যে কোনও প্রজাতির কচ্ছপই বিক্রি করা বা কেনা আইনত অপরাধ। জলজ প্রাণী বিশেষজ্ঞ নিলাদ্রি দাশগুপ্ত বললেন, ‘‘বাজারে বিক্রি হওয়া কচ্ছপের প্রজাতিটি বন্যপ্রাণ সুরক্ষা আইনের ‘শিডিউল ১’-এর আওতায় পড়ে। যে আওতায় রয়েছে বাঘ।’’ অর্থাৎ, বাঘ হত্যার সমান অপরাধ এই কচ্ছপ মেরে বিক্রি করার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
কিন্তু এ রকম খোলা বাজারে, কী ভাবে বিক্রি হচ্ছে কচ্ছপ? কিনছেনই বা কারা? এলাকায় কথা বলে জানা গেল, ওই বাজারে কচ্ছপের চাহিদা ভালই। আশপাশের অঞ্চল থেকে তো বটেই, বহু দূর থেকেও মানুষ কচ্ছপ কিনতে আসেন সেখানে। কচ্ছপের মাংস সুস্বাদু বলেই পরিচিত। তাই বিক্রিও চলছে সমানেই। হোক সে বিপন্ন প্রজাতির, হোক তার বিক্রি নিষিদ্ধ। মানুষের লালসা আর চাহিদার কাছে এগুলো কোনও বাধাই নয়। আর সেই চাহিদা বুঝেই আসতে থাকে জোগান।
মধ্যমগ্রামের বসুনগর বাজারে জনৈক খোকনদার কাছে প্রথম দিন গিয়ে কচ্ছপের কথা জিজ্ঞেস করতেই প্রশ্ন এল, ‘‘কতটা লাগবে?’’ উত্তর দেওয়ার পর ফোন ঘোরালেন তিনি। ‘‘গোল মাল হবে নাকি? ...আচ্ছা, ছোট? ঠিক আছে, খান তিনেক পাঠাতে হবে।’’ বিক্রেতাই জানালেন, বনগাঁর রহমানগেট থেকে নিয়ে আসা হয় প্রাণীগুলোকে। চাহিদা বেশি হলে কখনও কখনও ট্রাকে করেও আসে এলাকায়। এলাকা জুড়ে রমরমিয়ে চলছে বেচাকেনা। একটু খবর নিলেই জানা যায়, মধ্যমগ্রাম একা নয়। বাদ নেই ঠাকুরপুকুর বা সোদপুরের মতো শহরতলি এলাকা। ফোনে গোপন রফা করার পরেই ‘মাল’ চলে আসে চাহিদা মতো। দেদার বিক্রি, ঢালাও লাভ!
কী বলছে বন দফতর?
মধ্যমগ্রামের বাজারে কচ্ছপ বিক্রির কথা জানানোর পরেই উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বনাধিকারিক নিতাইকুমার সাহা বললেন, ‘‘আমাদের কাছে তো কোনও খবর নেই! আমি নিয়মিত এলাকার বাজারগুলোয় টহল দিই।’’ কিন্তু তার পরেও বন দফতরের নাকের ডগায় কী করে চলছে এমন কাজ? তাঁর উত্তর, ‘‘খবর পেলাম, যত দ্রুত সম্ভব পদক্ষেপ করবব।’’
এলাকায় কচ্ছপ বিক্রির খবর তাঁর কাছে কখনও আসেনি বলে জানালেন উত্তর চব্বিশ পরগনার পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায়ও। সাধারণত এই ধরনের ক্ষেত্রে উদ্ধার কাজের সময় স্থানীয় পুলিশের সহায়তা নেয় বন দফতর। ‘‘কিন্তু খবর পেলে আমরাও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ করি। ধরপাকড় করি। এ ক্ষেত্রেও ব্যবস্থা নিতে দেরি করব না।’’
খবর কি সত্যিই থাকে না? বারাসত রেঞ্জ অফিসেরই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মী জানালেন, খবর এ দিক ও দিক থেকে আসে বৈ কী! তবে এ ধরনের যে কোনও উদ্ধারকাজের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ, যন্ত্রপাতি ও গাড়ির ব্যবস্থা। তিনি বললেন, ‘‘আমাদের বিশেষজ্ঞ থাকলেও যন্ত্রপাতি বা গাড়ি নেই। এই যে এখন খবর পেলাম, কিন্তু এখনই ঘটনাস্থলে যাওয়ার উপায় নেই আমাদের।’’
পরিকাঠামোয় যে খামতি রয়েছে, মানলেন বন্যপ্রাণ শাখার বনপাল (সদর) শুভঙ্কর সেনগুপ্ত। তিনি জানালেন, সমস্ত রেঞ্জ অফিসে পর্যাপ্ত গাড়ি বা যন্ত্রপাতি জোগান দেওয়ার মতো আর্থিক সংস্থান দফতরের নেই। তবে এ ধরনের প্রাণী বিক্রির ক্ষেত্রে ধরপাকড়ের থেকেও বেশি প্রয়োজন সাধারণ মানুষের সচেতনতা। চাহিদা থাকলে তো ব্যবসা চলবেই। তিনি সাবধান করলেন, ‘‘কচ্ছপ বিক্রি করা যেমন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ, কচ্ছপ কেনাটাও ততটাই দণ্ডনীয় অপরাধ।’’
প্রধান মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) প্রদীপ ব্যাস জানালেন, ‘‘আর্থিক কারণে পরিকাঠামোর অভাবের কথা আমার জানা নেই। যে কোনও সময় যে কোনও নিষিদ্ধ প্রাণী বিক্রির খবর পেলেই পদ্ধতি মেনে উদ্ধার করি আমরা। ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের বিরুদ্ধেই বন্যপ্রাণ সুরক্ষা আইন মেনে পদক্ষেপ করা হয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy