Advertisement
১১ মে ২০২৪

নিরঞ্জনে ফিরে এল মিলনের সুর

গত কয়েক বছরে সুরটা কেটেছিল। এ বার দুর্গা প্রতিমা নিরঞ্জন উপলক্ষে ফের দুই বাংলার মিলনোৎসবের সাক্ষী থাকল টাকি। যথারীতি জোড়ানৌকার মাঝে প্রতিমা তুলে ইছামতীর বুকে ভাসান হল। দুই বাংলার মানুষ সাক্ষী থাকলেন সেই দৃশ্যের।

দেখা মিলল সেই পুরনো দৃশ্য। —নিজস্ব চিত্র।

দেখা মিলল সেই পুরনো দৃশ্য। —নিজস্ব চিত্র।

নির্মল বসু
টাকি শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৬ ০২:৪৯
Share: Save:

গত কয়েক বছরে সুরটা কেটেছিল। এ বার দুর্গা প্রতিমা নিরঞ্জন উপলক্ষে ফের দুই বাংলার মিলনোৎসবের সাক্ষী থাকল টাকি। যথারীতি জোড়ানৌকার মাঝে প্রতিমা তুলে ইছামতীর বুকে ভাসান হল। দুই বাংলার মানুষ সাক্ষী থাকলেন সেই দৃশ্যের।

২০১১ সালে টাকিতে বিসর্জনের দিন বাংলাদেশি বজরার সঙ্গে যাত্রী-বোঝাই ভারতীয় নৌকোর ধাক্কা লেগে জলে পড়ে মৃত্যু হয়েছিল এক ভারতীয় গবেষকের। সে বার ভাসান উৎসবের সুযোগে বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার মানুষ অবৈধ ভাবে ঢুকে পড়েছিল এ পারে। তা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয় নানা মহলে। ভাসানের দিন অবৈধ পারাপারের ভয়ে পরের বছরগুলিতে বন্ধ হয়ে যায় দুই বাংলার মিলনের উৎসব, প্রতিমা নিরঞ্জন।

এই অবস্থায় টাকি তো বটেই, রাজ্যের অসংখ্য মানুষের মনে ভেঙে গিয়েছিল। সকলেই চেয়েছিলেন, অনুপ্রবেশ বা শান্তি-শৃঙ্খলার দিকটি সামাল দিয়ে যেন টাকিতে ভাসানে পুরনো দিনের ছবি ধরে রাখা যায়। কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না পুলিশ-প্রশাসনের কাছে। বিশাল জল সীমানায় লক্ষ মানুষের ভিড়ে নজর রাখাটা চ্যালেঞ্জের ছিল বইকী! সম্প্রতি কাশ্মীরে জঙ্গি তাণ্ডবের ঘটনা যা চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।

এত সবের পরেও অবশ্য এ বার টাকিতে দুই বাংলার মানুষের অনুভূতির আদানপ্রদানের ছবিটা দেখা গিয়েছে। অনুপ্রবেশও রোখা গিয়েছে বলে দাবি পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের। কোনও দুর্ঘটনাও ঘটেনি।

বিএসএফ, বিবিজি এবং উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশ-প্রশাসনকেই এ জন্য কৃতিত্ব দিচ্ছেন টাকির মানুষ। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) আনন্দ রায় বলেন, ‘‘টাকিতে ত্রিস্তর নিরাপত্তা বেষ্টণীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দু’দেশের মধ্যে মাঝনদীতে নৌকো দিয়ে সীমান্ত রেখা গড়ে পুলিশি নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়। এ জন্য শতাধিক পুলিশের পাশাপাশি বিএসএফ জওয়ানেরাও ছিলেন। সব কিছু শান্তিপূর্ণ ভাবে শেষ হয়েছে।’’

বসিরহাট মহকুমার টাকির অন্য পারে বাংলাদেশের শ্রীপুর, পারুলিয়া, ভাতসালা, শাকরা, দেভাটা, ঘলঘলে গ্রাম। এত দিন দুই প্রতিবেশী দেশের মানুষ নিজের নিজের দেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে জাতি-ধর্ম ভূলে ভাসানের দিনে ইছামতীর বুকে ভেসে বেড়াতেন। একে অন্যের দিকে ফুল-মিষ্টি ছুড়ে পরিচয় বিনিময় করতেন। ভাসান দেখতে দু’দেশের মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতেন। একই সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ— দু’দেশের দুর্গা প্রতিমাই নিরঞ্জন হতো।

এ বার সেই সুর অনেকটাই ফিরে এল টাকিতে। জলপথে সীমান্ত রেখা মেনে এক দেশের নৌকোর মানুষ অন্য দেশের নৌকোর যাত্রীদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। দুই বাংলার মানুষের মধ্যে চকোলেট, ফল বিলি হয়েছে। কোলাকুলি করতে দেখা গিয়েছে অনেককে।

তবে টাকির এ পারে যে ভাবে প্রতিমা এবং যাত্রীর নৌকা দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশের দিকে তেমনটা ছিল না। সে দেশের পারে নদীর ধারে ডাঙায় একটি মাত্র প্রতিমা চোখে পড়েছে। এ দিন টাকিতে ইছামতীর মাঝ বরাবর বিএসএফের জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। নদীর মাঝ বরাবর সীমানা ভাগ করে ছিল নৌকো। কয়েকটি লঞ্চ এবং দর্শনার্থীদের নৌকো ছিল। নদীর পাড়ে বিএসএফ জওয়ান এবং পুলিশি টহল ছিল প্রচুর সংখ্যায়। টাকি পুরভার লঞ্চটি রঙ-বেরঙের বেলুন এবং দেশের পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছিল। উপস্থিত ছিলেন পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তারা। বসিরহাটের সাংসদ ইদ্রিশ আলি, বিধায়ক দীপেন্দু বিশ্বাস, বসিরহাট ও টাকির পুরপ্রধান সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, তপন সরকারেরাও ছিলেন। সোমনাথবাবু বলেন, ‘‘সীমান্তে কোনও সমস্যা না থাকায় নদীতে অন্য বারের থেকে বেশিই নৌকো নেমেছিল। পাড়ে দাঁড়িয়ে অগুনতি মানুষ প্রতিমা নিরঞ্জন দেখেছেন। আনন্দ করেছেন। সীমান্ত রেখা মেনে বাংলাদেশের মানুষও আনন্দ করেছেন।’’

টালিগঞ্জ থেকে আসা স্বপন নন্দী, কল্পনা ভৌমিক, নন্দরাম শিকদার বলেন, ‘‘নদীর বুকে জোড়া নৌকোর মাঝে প্রতিমার বিসর্জন এবং দুই বাংলার মানুষের মিলনের দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে টাকিতে ছুটে আসা। গত কয়েক বছর তা না হওয়ায় বিসর্জনের জৌলুস অনেকটাই কমে গিয়েছিল। এ বার কম হলেও তা ফের সমহিমায় ফিরে আসায় আমরা আনন্দিত।’’

টাকি পুর গেস্টহাউসের দিকে দেখা যায় এক বিদেশিনিকে ভাসানের ছবি ক্যামেরা-বন্দি করতে। অস্ট্রিয়ার ওই তরুণী এভেলিম তো রীতিমতো উচ্ছ্বসিত। জানালেন, ভাসানের কথা শুনেছিলেন। কিন্তু একটা উৎসবকে কেন্দ্র করে দু’টো দেশ যে এমন ভাবে একাত্ম্য হতে পারে, তা দেখে তিনি অভিভূত। তরুণীর কথায়, ‘‘গোটা বিশ্বের নানা প্রান্তে এমন অস্থির পরিবেশের মধ্যেও দু’টো দেশ এ ভাবে এক সঙ্গে মিলে আনন্দে সামিল হতে পারে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

taki immersion
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE