Advertisement
০৪ মে ২০২৪
আক্ষেপ শিল্পোদ্যোগীদের

জমি কিনে ফেঁসে গিয়েছি প্রায় সারদার মতোই

এলাকায় ইস্পাত কারখানা গড়া চলছিল। সে জন্যই ছিল আশপাশে অনুসারী শিল্প গড়তে জমি কেনার ব্যস্ততাও। এখন প্রকল্প স্থগিত। তাই কিনে রাখা জমি যেন গিলতে আসছে ছোট শিল্পোদ্যোগীদের।

সুমন ঘোষ
শালবনি শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৫ ০৩:১৯
Share: Save:

এলাকায় ইস্পাত কারখানা গড়া চলছিল। সে জন্যই ছিল আশপাশে অনুসারী শিল্প গড়তে জমি কেনার ব্যস্ততাও। এখন প্রকল্প স্থগিত। তাই কিনে রাখা জমি যেন গিলতে আসছে ছোট শিল্পোদ্যোগীদের। পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিতে স্থগিত হয়ে যাওয়া ইস্পাত কারখানা লাগোয়া এলাকায় চড়া দামে জমি কিনে যাঁরা পস্তাচ্ছেন। জমি বেচেও দিতে চান অনেকে। কিন্তু খদ্দের নেই। বিপাকে পড়া শিল্পোদ্যোগীরা সমস্বরে বলছেন, ‘‘ওখানে জমি কেনাটা প্রায় সারদায় টাকা রাখার মতো হয়ে যাবে, বুঝিনি!’’

২০০৭-১১— এই পাঁচ বছরে শালবনির ওই এলাকায় কয়েকশো একর জমি হাত বদলায়। জিন্দলেরা এলাকায় নির্মাণ শুরু করার পরে বিঘা প্রতি এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা দামের জমি রাতারাতি বিক্রি হয় ১৮-২০ লক্ষ টাকায়। বালেশ্বর-আসানসোল জাতীয় সড়কের ধারে দাম ছিল আরও চড়া, বিঘা প্রতি ৩০ লক্ষ ছুঁইছুঁই। সব আশায় দাঁড়ি পড়ে ২০১৪-র ৩০ নভেম্বর। সে দিন কলকাতায় সংস্থার চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর সজ্জন জিন্দল জানিয়ে দেন, শালবনিতে কারখানা তৈরির কাজ স্থগিত করা হল।

ইস্পাতভিত্তিক অনুসারী শিল্প করার আশায় জিন্দল প্রকল্পের পাশে প্রায় দেড় একর জমি কিনেছিলেন অপু আইচ। তাঁর কথায়, “প্রথমে ৮-১০ লক্ষ টাকাতেও এক একর (আড়াই বিঘায় এক একর) জমি পেয়েছি। পরে ৩০ লক্ষ টাকা দিয়ে এক বিঘা জমি কিনতে হয়েছিল! জিন্দলদের কারখানা হল না। লগ্নি করা টাকা ফেঁসে গেল।’’

আর এক শিল্পোদ্যোগী দেবাশিস পালের দাবি, ২০১০-এ কারখানায় পাঁচিল দেওয়া শুরু হতেই জমির দাম বাড়ে। পরে জাতীয় সড়ক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে, কারখানার পিছনেও জমির দাম দাঁড়ায় বিঘা প্রতি ১৫-১৬ লক্ষ টাকা! এখন দাম কত? দেবাশিসবাবুর জবাব, “কে জানে। খদ্দেরই তো নেই।”

শালবনি থানার বাকিবাঁধ, বাঁশকোপনা, আসনাশুলি, বরজু, শালডাংরা, নূতনডিহি, চন্দনকাঠ, আড়াবাড়ি এলাকায় ৪,৩৩৪ একর জমিতে জিন্দলদের কারখানা গড়া শুরু হতেই এলাকার অর্থনৈতিক ছবি বদলানোর ইঙ্গিত মিলতে শুরু করে। নির্মাণে জড়িত শ্রমিক-কর্মীরা প্রকল্প এলাকায় থাকতে শুরু করায় কারখানার গেটের বাইরে বেশ কয়েকটি দোকান গড়ে ওঠে। তার মধ্যে মুরগির মাংসের দোকান যেমন ছিল, তেমনই ছিল চায়ের দোকান, পান-গুমটি। কারখানার কাজ স্থগিত হয়ে যাওয়ায় সে সব দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। এলাকার যে আড়াইশো কর্মহীন যুবক-যুবতীকে বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন জিন্দলেরা মাথায় হাত তাঁদেরও। বলছেন, ‘‘অনেক আশা নিয়ে কাজ শিখেছিলাম। কারখানাটা হলে কত কাজের সুযোগ হতো। কিছুই হল না!’’

এই আক্ষেপই যেন শালবনির সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধছে হুগলির সিঙ্গুরকে। ২০০৬ নাগাদ সিঙ্গুরে টাটাদের ন্যানো কারখানার সুবাদে জমির দাম লাফিয়ে বাড়ছিল। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে লাগোয়া এলাকায় হোটেল, বিভিন্ন ব্যাঙ্কের শাখা খোলার তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। ছোট হোটেল, চায়ের দোকান যেমন হয়, প্রকল্প এলাকার বাইরে বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগীরাও জমি কেনেন। গাড়ি কারখানায় উৎপাদন শুরুর পরে স্থানীয় চাহিদা অনুয়ায়ী শিল্প গড়ার লক্ষ্য ছিল তাঁদের।

সিঙ্গুরের জয়মোল্লা এলাকায় ১২ বিঘা জমি কিনে ছিলেন বিজন দাস (নাম পরিবর্তিত)। ভেবেছিলেন, আইসক্রিম কারখানা গড়বেন। বাইরে থেকে প্রচুর মানুষ চাকরির সূত্রে সিঙ্গুরে আসবেন। অনেকে স্থায়ী ভাবে বাস করবেন। তাই চাহিদার কোনও সমস্যা হবে না। এখন আক্ষেপ করেন, ‘‘সবই জলে গেল!’’ একই হতাশা বিকাশ দাসের (নাম পরিবর্তিত)। তিনি একটি স্কুল করে ফাঁপরে পড়েছেন। বললেন, ‘‘আশা ছিল, ভাল মানের স্কুল করলে মধ্যবিত্ত পরিবারের বহু ছেলেমেয়ে তাতে পড়বে। কোথায় কী?’’

প্রকল্প এলাকার আশপাশে জমি কিনে রাখা ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগীদের একটা বড় অংশের দাবি, সিঙ্গুরে টাটাদের নাম শুনে বহু অনুসারী শিল্প এসেছিল ভারতের নানা প্রান্ত থেকে। ভিন্-রাজ্যের সেই শিল্পপতিদের সঙ্গে এ রাজ্যের শিল্পোদ্যোগীদের যোগসূত্র গড়ে ওঠে। পারস্পরিক আদানপ্রদানে এখানে শিল্প সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ২০০৮-এ ন্যানোর সঙ্গে সেই শিল্প সম্ভাবনাও গিয়েছে।

জিন্দলদের কারখানা চালুর দাবিতে সংগঠন গড়ে শালবনিতে আন্দোলনে নেমেছেন স্থানীয় জমিহারারা। ‘শালবনি জেএসডব্লিউ বেঙ্গল স্টিল লিমিটেড ল্যান্ড লুজার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক পরিষ্কার মাহাতো বলেন, ‘‘আজ যে সব ছোট-ছোট শিল্পোদ্যোগী ফেঁসে গিয়েছেন, কারখানাটা হলে তাঁরাও নতুন শিল্প খোলায় উৎসাহ পাবেন। কত লোকের কাজ হবে! এলাকার চেহারাটাই বদলে যাবে, ভাবুন তো এক বার!’’

সহ-প্রতিবেদন: গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE