Advertisement
E-Paper

ছুটছে কথা অনর্গল, ক্ষোভ যে তৃণ-মূলে

দলনেত্রীর কঠোর বার্তাই সার। দলের বিরুদ্ধে মুখ খোলার হাওয়া ক্রমশ তৃণমূল স্তরে পৌঁছে যাচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে দূর দূরান্তে। ভাঙড় থেকে পূর্বস্থলী হয়ে পুরুলিয়া বা আলিপুরদুয়ার নেতৃত্বের একাংশের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ জানাতে শুরু করেছেন তৃণমূল নেতারা। দু’দিন আগেই প্রকাশ্যে দলের বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ এনেছেন পূর্বস্থলী উত্তর কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়। ওই ঘটনায় যথেষ্ট অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে দলীয় নেতৃত্বকে। ভাঙড়েও আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ তুলে সরব হয়েছিলেন একাধিক তৃণমূল নেতা-কর্মী। অভিযোগকারী এক প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধানকে গ্রেফতার করা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৪০

দলনেত্রীর কঠোর বার্তাই সার। দলের বিরুদ্ধে মুখ খোলার হাওয়া ক্রমশ তৃণমূল স্তরে পৌঁছে যাচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে দূর দূরান্তে। ভাঙড় থেকে পূর্বস্থলী হয়ে পুরুলিয়া বা আলিপুরদুয়ার নেতৃত্বের একাংশের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ জানাতে শুরু করেছেন তৃণমূল নেতারা।

দু’দিন আগেই প্রকাশ্যে দলের বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ এনেছেন পূর্বস্থলী উত্তর কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়। ওই ঘটনায় যথেষ্ট অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে দলীয় নেতৃত্বকে। ভাঙড়েও আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ তুলে সরব হয়েছিলেন একাধিক তৃণমূল নেতা-কর্মী। অভিযোগকারী এক প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধানকে গ্রেফতার করা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি।

এই রেশ কাটতে না কাটতেই বৃহস্পতিবার ফের বোমা ফাটিয়েছেন পুরুলিয়ার এক তৃণমূল নেতা। ‘যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ’এই উপমা দিয়ে এ দিন দলেরই শাখা সংগঠনের সভায় তৃণমূলের ব্লক নেতৃত্বকে তুলোধোনা করেছেন অঙ্কুর বাউরি নামে ওই নেতা। তাঁর আক্রমণের নিশানায় ছিলেন রঘুনাথপুরের তৃণমূল বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরিও! অঙ্কুরবাবু এ ভাবে সরব হওয়ায় যৎপরোনাস্তি অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে জেলার তৃণমূল নেতৃত্বকে। বলতে হয়েছে, “ওঁর মাথার ঠিক নেই!” জেলা তৃণমূল সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো আবার দাবি করেছেন, “উনি বর্তমানে আমাদের দলের কেউ নন!” তা হলে তিনি দলের সংগঠনের মঞ্চে ছিলেন কেন? এ প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। বিরোধীরা কটাক্ষ করে বলছেন, তৃণমূলে এটাই দস্তুর! অস্বস্তিতে পড়লে দায় ঝেড়ে ফেলা।

বুধবারই পৈলানে দলীয় কর্মিসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “যদি দলীয় কোনও বিষয়ে অভিযোগ থাকে, তা হলে নির্দিষ্ট অভিযোগ করুন। কাউকে ফাঁদে ফেলবেন বলে অভিযোগ করবেন না!” তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই রঘুনাথপুরের অভিযোগ সামনে এসেছে। সেই প্রসঙ্গ টেনেই তৃণমূলের এক রাজ্য নেতার বক্তব্য, “স্বয়ং দলনেত্রী পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, অভিযোগ থাকলে দলেই নির্দিষ্ট করে জানাতে হবে। নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে পুরুলিয়ার ওই নেতা বা অন্য কেউ দলকে জানান। দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবে।”

এই যুক্তিতেই দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তিরস্কৃত হতে হয়েছে বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়কে। যদিও তাতে দমে যাওয়া দূর অস্ত, বরং তপনবাবুর পাশে দাঁড়িয়ে তোলাবাজি নিয়ে সরব হয়েছেন বর্ধমানের আরও কিছু তৃণমূল নেতা। কী ভাবে তোলাবাজি চলছে, পূর্বস্থলীর বিভিন্ন স্তরের নেতারা তা শীর্ষ নেতৃত্বকে চিঠি দিয়ে জানানোর সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। অঙ্কুর বাউরিও এ দিন দাবি করেছেন, তিনি যা বলেছেন দলের বাইরে বলেননি। দলেরই শাখা সংগঠনের সভায় বলেছেন। এবং তিনি কোনও অন্যায় করেননি।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, এ রাজ্যে বামেদের ৩৪ বছরের শাসনের শেষ দিকে এমন শুরু হয়েছিল। আগে বিনয় চৌধুরীর মতো প্রবীণ দু’এক জন কখনও সখনও বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে দলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে লাগাতার মুখ খুলতে দেখা গিয়েছিল অনেককেই। অথচ তৃণমূলের ক্ষেত্রে তার সাড়ে তিন বছরের শাসনকালেই প্রায় প্রতি দিন কেউ না কেউ মুখ খুলছেন! এবং শীর্ষ নেতৃত্ব চেষ্টা করেও বিক্ষুব্ধদের রাশ টানতে পারছেন না। শাসক দলেরই এক নেতার কথায়, “শীর্ষ কোনও নেতা, বিধায়ক বা সাংসদ কিছু বললে না হয় এক ভাবে সামাল দেওয়া যায়। যেমন ভাবে সতর্ক করা হয়েছে শিশির অধিকারী, অখিল গিরি বা তপন চট্টোপাধ্যায়কে। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে, জেলার ছোট ছোট নেতা-কর্মীও প্রকাশ্যে দলের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন। এটাই আশঙ্কার।”

কী বলেছেন অঙ্কুর বাউরি?

বৃহস্পতিবার পুরুলিয়া শহরের মানভূম ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনে ছিল তৃণমূলের তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং ওবিসি সেলের জেলা সম্মেলন। তারই মঞ্চে বক্তৃতা দিতে উঠে রঘুনাথপুর ১ ব্লকের সভাপতি অঙ্কুরবাবু এ দিন অভিযোগ করেন, “জঙ্গলমহলে উন্নয়ন হলেও আমরা তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং ওবিসি-রা সব সময় অবহেলিত। বিধায়ক, সাংসদ, পঞ্চায়েত সব আমাদের। অথচ আমরা অবহেলিত আর বিতাড়িত হয়েই রয়েছি!”

এখানেই না থেমে এর প্রভাব রঘুনাথপুর বিধানসভা এলাকায় কী ভাবে পড়েছে, তার উদাহরণও দেন অঙ্কুরবাবু। তিনি জানান, রঘুনাথপুর কেন্দ্রে গত বিধানসভা নিবার্চনে ১৩ হাজার ভোটের ‘লিড’ ছিল। সেই ‘লিড’ চলতি লোকসভা ভোটে সাড়ে ৪ হাজারে নেমে এসেছে। এর পরেই তিনি বলে ওঠেন, “আসলে রঘুনাথপুরে রোগ ঢুকে গিয়েছে। এই রোগ সারাতে ভাল চিকিৎসক, মানে সার্জেন প্রয়োজন। তা হলেই দল পুরনো জায়গায় ফিরবে।”

অঙ্কুরবাবুর মন্তব্যে অস্বস্তিতে পড়ে যান সংগঠনের নেতারা। তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং ওবিসি সেলের পুরুলিয়া জেলার সভানেত্রী তথা জেলা পরিষদের সহকারী সভাধিপতি মীরা বাউরি উঠে দাঁড়িয়ে অঙ্কুরবাবুকে কিছু একটা বলতে যান। তাতে কাজ হয়নি। মাইক ধরেই অঙ্কুরবাবু বলে ওঠেন, “আমাকে বলতে বাধা দেওয়া হচ্ছে! যেটা দেখেছি, আমি সেটাই তুলে ধরলাম।” এর পরেই তাঁর মন্তব্য, “যারা লঙ্কায় যায়, তারাই রাবণ হয় এবং আমাদের রক্ত চুষে খায়!”

এই মন্তব্যের পরে তুমুল হাততালি দিতে দেখা যায় শ্রোতাদের। মঞ্চ থেকে নেমেও নিজের ক্ষোভ উগরে দেন ওই নেতা। রঘুনাথপুরের বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরিকে আক্রমণ করে বলেন, “আমাদের এলাকায় কোনও উন্নয়ন হয়নি, তাই বলতে বাধ্য হয়েছি। বিধানসভার আগে কাঁধে করে বিধায়ককে নিয়ে ঘুরেছি। আর আজ বিজেপি তরতরিয়ে উঠছে! কারণ কী? কারণ, একমাত্র বিধায়ক!” অঙ্কুরবাবুর আরও দাবি, মঞ্চে তাঁর আরও অনেক কথা বলার ছিল। যা তাঁকে বলতে দেওয়া হয়নি। তিনি দাবি করেন, “আজ বিধায়কের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। পার্টিতে বেনোজল ঢুকে যাচ্ছে। আর আমাদের মতো পুরনো কর্মীদের ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে।”

প্রকাশ্যে মুখ খুলে আপনি তো শাস্তির মুখে পড়তে পারেন?

দমে না গিয়ে অঙ্কুরবাবু বলেন, “শাস্তি হলে হবে। যা সত্যি, তাই বলেছি। আমাদের তো দল সাসপেন্ড করেছিল। দেখা গেল, বিজেপি বাড়ছে। তাই ফেরত নেওয়া হল।” অঙ্কুরবাবু যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন, সেই সময় সংগঠনের কিছু কর্মী ও খোদ জেলা সভানেত্রী এগিয়ে এসে তাঁকে মঞ্চে ফেরত নিয়ে যান। মীরাদেবী বলেন, “ওঁর মাথার ঠিক নেই।” আর বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরি বলেন, “এ ব্যাপারে যা বলার সংগঠনের জেলা নেতৃত্বই বলবেন।”

এ দিন একই সুরে বিধায়কের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মুখ খুলেছেন আলিপুরদুয়ার জেলার তৃণমূল নেতা-কর্মীদের একাংশও। তাঁদের অভিযোগ, স্থানীয় জটেশ্বর লীলাবতী মহাবিদ্যালয়ে অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ক্যাশিয়ার ও করণিক পদে নিয়োগে স্বজনপোষণ করেছেন ফালাকাটার বিধায়ক অনিল অধিকারী। ওই তিন পদে নিয়োগপত্র পেয়েছেন অনিলবাবুর ছেলে জয়ন্ত, অনিল-ঘনিষ্ঠ স্থানীয় তৃণমূল নেতা সমরেশ পালের ভাগ্নে প্রিয়ঙ্কর দাস এবং এক তৃণমূল কর্মী সুদীপ্ত ঘোষ। জটেশ্বরের তৃণমূল নেতা নির্মল দাসের ক্ষোভ, “গোড়া থেকে আমরা তৃণমূলে। সিপিএমের স্বজনপোষণ নিয়ে কত আন্দোলন করেছি। এখন দলেরই বিধায়ক নিজের ছেলেকে যে ভাবে চাকরি পাইয়ে দিলেন, তা মেনে নিতে পারছি না।”

এ দিনই আবার বীরভূমের মহিলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভানেত্রী ফাল্গুনী সিংহের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও তোলাবাজির অভিযোগ সম্বলিত লিফলেট বিলি হয়েছে মুরারই অঞ্চলে। তাতে প্রাথমিক শিক্ষক-সিভিক ভলান্টিয়ার-ভিলেজ পুলিশ নিয়োগ থেকে ঠিকাদারদের কাছ থেকে মোটা টাকা তোলার অভিযোগ করা হয়েছে। এমনকী, ‘মুরারই বিধানসভা তৃণমূল যুব কংগ্রেস’ নামে ছাপানো ওই লিফলেটে ফাল্গুনীদেবীর বিরুদ্ধে দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের নাম করেও তোলা আদায়ের অভিযোগ আনা হয়েছে। রামপুরহাটের বিধায়ক তথা মন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এটা দলবিরোধী কাজ। যারা এটা করেছে তাদের খুঁজে বের করে দল থেকে বহিষ্কার করতে নির্দেশ দিয়েছি।”

কিন্তু ধারাবাহিক ভাবে দলের মধ্য থেকেই এমন অভিযোগ উঠছে কেন? সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কথায়, “তৃণমূল জমানায় অনুন্নয়ন আর তোলাবাজি অঙ্কুরিত থেকে এখন পল্লবিত হচ্ছে! অঙ্কুর বাউরি সেটাই স্পষ্ট করে দিয়েছেন।” বিজেপি-র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের মন্তব্য, “তৃণমূলের এখন মুষল-পর্ব! সাড়ে তিন বছরে বেশির ভাগ জায়গায় তারা বিরোধী বলে কিছু রাখেনি। বখরা নিয়ে নানা জায়গাতেই তাদের মধ্যে বিরোধ বাধছে। ওই দলে কে সাধু কে নয়, কে ধরবে!” কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা মানস ভুঁইয়ার মতে, “অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে কোনও দল এমন অভিযোগ এড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরাই অভিযোগ করছেন। ফলে দলের নেতৃত্ব তো বটেই, প্রশাসনেরও সক্রিয় হওয়া উচিত।”

tmc purulia ankur bauri internal problem state news online state news tmc internal problem agitation group agitation
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy