Advertisement
E-Paper

নোটের আকালেও বাঙালি মেমে-চিত্তে

আমেরিকা ভোট গুনছে, ভারত নোট গুনছে— হপ্তাখানেক আগে এই একটা লাইনেই যেন শুরু! সে আর থামছেই না। কালো টাকা উদ্ধার হয়ে আম-বাঙালির সুবিধা হোক বা না হোক, বাঙালির রঙ্গ-ব্যাঙ্কের লকার যেন হাট করে খুলে দেওয়া হয়েছে।

সুজিষ্ণু মাহাতো

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৫

আমেরিকা ভোট গুনছে, ভারত নোট গুনছে— হপ্তাখানেক আগে এই একটা লাইনেই যেন শুরু!

সে আর থামছেই না।

কালো টাকা উদ্ধার হয়ে আম-বাঙালির সুবিধা হোক বা না হোক, বাঙালির রঙ্গ-ব্যাঙ্কের লকার যেন হাট করে খুলে দেওয়া হয়েছে। আর সেখান থেকে রোজ বেরোচ্ছে একের পর এক মণিমুক্তো। ছবিতে নানা সংলাপ বসিয়ে তৈরি করা পোস্টার, যা ‘ইন্টারনেট মেমে’ নামেই পরিচিত। সেই সব ‘মেমে’ ছড়িয়ে পড়ছে ফেসবুকের ওয়ালে, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে। কোনও মেমে-তে ফেলুদা জটায়ুকে বলছে সোনার কেল্লা বা গণেশ মূর্তি নয়, বেশি কঠিন হল কোন এটিএমে টাকা আছে তা খোঁজা। কোথাও তোপসে দূরবীন নিয়ে ফেলুদাকে বলছে, ওই দ্যাখো ওই এটিএমে টাকা আছে!

ফেলুদা-তোপসে-জটায়ুই নন, ‘মেমে’ তৈরি হচ্ছে রঞ্জিৎ মল্লিক, সুখেন দাসের ছবির নানা দৃশ্যে কাল্পনিক সংলাপ বসিয়েও। বাঙালির রঙ্গের বাঁধ যেন ভেঙে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সকাল হতে না হতেই ফোনে আসছে কবিগুরুর গানের প্যারডি, ‘‘ভেঙে মোর ১০০০ টাকা দিয়ে যাবি কে আমারে, ও বন্ধু আমার! না পেয়ে ১০০ টাকা পকেট ফাঁকা, দিন যে আমার কাটে না রে...’’ আবার রাতেই হয়তো এল, ‘‘ভাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এ বার যাবার আগে।’’

কেবল রবীন্দ্রসঙ্গীতই নয়, প্যারডি চলছে একেবারে আধুনিক কবিতা নিয়েও। শ্রীজাতর ‘তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ার’ প্যারডি করে তৈরি হয়েছে, ‘‘তোমার টাকা আমার টাকা, তফাৎ শুধু খুচরোতে।’’

সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেও স্বচ্ছন্দ শ্রীজাত ভার্চুয়াল রসিকতাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। তাঁর মতে, ‘‘এখনও রাস্তার ধারে, চায়ের দোকানে কেউ কেউ আড্ডা মারেন। কিন্তু অনেকেরই সেই সময়টা নেই। সোশ্যাল মিডিয়া তাঁদের এই সুযোগটা দিয়েছে। তার ফলেই উঠে আসছে রঙ্গ-রসিকতা।’’ তবে তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘অনেক সময়ই মেমে-তে তারকাদের কুৎসিত ইঙ্গিত করে মজা করা হয়। সেটা পাড়ার আড্ডায় কখনও হতো না।’’

নোট-রঙ্গে যদিও নির্মল আনন্দের ভাগই বেশি। যেমন স্কুলের বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রবাসী এক বন্ধু লিখলেন, ‘‘এর মধ্যে কে আবার মোদীজিকে মেল করে জানতে চেয়েছে যে ২০০০-এর নোটে যে চিপ আছে তাতে গান ভরা যাবে কি না।’’ সঙ্গে সঙ্গে আর একজনের জবাব, ‘‘কেউ নাকি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দরজায় কার্তিক ফেলে এসেছে!’’

রঙ্গ-তামাশার এই নতুন রূপ খুবই উপভোগ করছেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বললেন, ‘‘ইউটিউব-ইনস্টাগ্রামেও আজকাল এত সূক্ষ্ম হাস্যরসের খোঁজ মিলছে, যা সত্যিই উপভোগ্য।’’ তাঁর একটাই আক্ষেপ, ‘‘এত মধুর হাস্যরস উৎকৃষ্ট সাহিত্যে পরিণত হতে পারছে না!’’

বাঙালির রসবোধ বরাবরই প্রখর। অসংখ্য সাহিত্যকর্মে তার স্বাক্ষরও রয়েছে। কিন্তু মাঝে তা যেন খানিক মুখ লুকিয়ে ছিল। প্রায় আড়াই দশক আগের ঘটনা। ৪১বি রুটের বাসে প্রতিবন্ধীর আসনে সমর্থ যাত্রীকে বসতে দেখে পাশের অফিসযাত্রী খেদোক্তি করলেন, ‘‘গোটা জাতিটাই তো প্রতিবন্ধী হয়ে গেল!’’ সোশ্যাল মিডিয়া আসার পরে এই সব টুকরোটাকরা মণিমাণিক্যই ফিরে আসছে মেমে হয়ে। তাই তো হোয়াটসঅ‌্যাপে ভাইরাল হচ্ছে পোস্টার, ২০৫৫ সালে এক খুদে বাবাকে জিজ্ঞাসা করছে মাকে প্রথম দেখার কথা। বাবা বলছেন, ব্যাঙ্কের লাইনে ৫-৬ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম, প্রেম হয়ে গেল!

তবে রঙ্গ কি কেবল মনের আরাম? তার মধ্যে রয়েছে প্রতিবাদের ভাষাও। আগেকার দিনে, বিদূষকেরা তো কতকটা তেমন ভূমিকাই পালন করতেন। এখন দিন বদলেছে। কিন্তু ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের জোর কমেনি। সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায়ের মতে, ‘‘বাঙালির রসবোধ প্রবল। কিন্তু এই রসিকতার ভাষা লঘু হলেও তার মধ্যে একটা প্রতিবাদের ইঙ্গিত রয়েছে।’’

আবার মনোবিদদের মনে হচ্ছে নিজের অবস্থা নিয়ে এই রঙ্গ-রসিকতা এখন সত্যিই প্রয়োজন। ‘‘এগুলো আসলে অসহায় পরিস্থিতিতে জেগে ওঠা নেতিবাচক প্রবণতাগুলো নিয়ন্ত্রণের খুব পরিণত অস্ত্র,’’ বলছেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Demonetization ATM Money
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy