হাজারো ডাকাডাকি সত্ত্বেও যে-সব কারণে বাংলায় শিল্প আসছে না, জমি-জট তার অন্যতম।
কিন্তু জমির সমস্যা নেই, এমন কিছু যৌথ প্রকল্পেও বেসরকারি অংশীদার মিলছে না। যেমন ‘পুলিশ পাবলিক মডেল স্কুল’ প্রকল্প। তাতে সঙ্গী মিলছে না শর্তের গুরুভারে।
বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে (পিপিপি মডেল) রাজ্য সরকার ‘পুলিশ পাবলিক মডেল স্কুল’ তৈরি করবে বলে ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই স্কুলে পুলিশের ছেলেমেয়েরা কম খরচে লেখাপড়া করবে। তাদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকবে। কিন্তু কোন পথে এই স্কুল তৈরি হবে, তা খুঁজতেই এক বছর পেরিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত এক মাস সময় দিয়ে প্রকল্পে অংশীদার হতে আগ্রহীদের কাছ থেকে আবেদনপত্র চেয়ে গত ১৫ মে নিজেদের ওয়েবসাইট ও সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেয় পুলিশ। নবান্নের খবর, সেই সময়সীমা শেষ হয়ে গেলেও আদৌ কোনও সাড়া মেলেনি।
বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, ৯৯ বছরের লিজ চুক্তিতে স্কুল তৈরির জন্য জমি দেবে রাজ্য। তবে এর জন্য ওই জমির বাজারদরের তিন শতাংশ টাকা বছরে ভাড়া হিসেবে দিতে হবে যৌথ উদ্যোগের অংশীদার বেসরকারি সংস্থাকে। সেই সঙ্গে জমির দামের ৯৫ শতাংশ সেলামি নেবে সরকার। আর স্কুল গড়ার খরচ দিতে হবে বেসরকারি সংস্থাকেই। এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘আসানসোল এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের সালুয়ায় যৌথ উদ্যোগে (পিপিপি) দু’টি স্কুল তৈরির পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিজ্ঞাপনে সাড়া না-মেলায় তা স্থগিত হয়ে গিয়েছে।’’
সাড়া মিলল না কেন?
‘‘এই প্রকল্পের জন্য জমি জোগাড়ের সমস্যা না-থাকলেও স্কুল পরিচালনার ক্ষেত্রে যে-সব শর্ত দেওয়া হয়েছে, কোনও বেসরকারি সংস্থাই সেগুলো মানতে চায়নি। কারণ, ওই সব শর্ত মানতে গেলে স্কুল পরিচালনার কোনও দায়িত্বই কার্যত তাদের হাতে থাকবে না,’’ সাড়া না-মেলার ব্যাখ্যা দিলেন নবান্নেরই এক কর্তা।
শর্তগুলো কী?
শর্তাবলির মধ্যে আছে: l প্রস্তাবিত স্কুলের ৩৫ শতাংশ আসন পুলিশকর্মীদের ছেলেমেয়ের জন্য ‘সংরক্ষিত’ রাখতে বাধ্য থাকবে বেসরকারি সংস্থা। l বাকি আসনে নিজেদের মতো পড়ুয়া ভর্তি করা গেলেও মানতে হবে সরকারি নিয়ম। অর্থাৎ বাকি ৬৫ শতাংশ আসনের ক্ষেত্রেও বেসরকারি সংস্থার হাতে পূর্ণ স্বাধীনতা থাকছে না। l স্কুলে দু’রকমের ফি-র ব্যবস্থা রাখতে হবে। একটি পুলিশের ছেলেমেয়েদের জন্য, অন্যটি বাইরের ছাত্রছাত্রীদের। পুলিশকর্মীদের ছেলেমেয়ের ফি নির্ধারিত হবে সরকারি স্কুলের ফি-র সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। অর্থাৎ তাদের ক্ষেত্রে লেখাপড়ার খরচ হবে নামমাত্র। আর বাইরে থেকে যে-সব ছাত্রছাত্রী ভর্তি হবে, তাদের ফি নির্ধারণ করবে স্কুলের পরিচালন সমিতি। l বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, পিপিপি মডেলে গড়ে ওঠা স্কুলের পরিচালন সমিতিতে রাখতে হবে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব, স্কুলশিক্ষা সচিব এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে।
পরিচালনা আর ফি সংক্রান্ত শর্ত এত ভারী লাগছে যে, কেউ এই প্রকল্পে এগিয়ে আসতে চাইছে না। প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্য প্রশাসনের তিন তাবড় কর্তা স্কুলের পরিচালন সমিতিতে থাকলে বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা কী ভাবে নিজেদের মত প্রকাশ করবেন? আর করলেও তা আদৌ গ্রাহ্য হবে কি? স্কুল তৈরির জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করার পরে ছাত্র ভর্তি, ফি নির্ধারণ, এমনকী স্কুল পরিচালনাতেও যেখানে বেসরকারি সংস্থার কার্যত কোনও স্বাধীনতা থাকবে না, সেখানে কেউ এগিয়ে আসবে কেন?
ফি নিয়েও শর্তের ভার পিছিয়ে দিচ্ছে বেসরকারি সংস্থাকে। নবান্নের একাংশের বক্তব্য, স্কুল চালানোর জন্য পরিচালকেরা সকলের কাছ থেকে সমান হারে ফি বা আনুষঙ্গিক অনুদান নিতে পারবেন না। সে-ক্ষেত্রে পুলিশকর্মীদের ছেলেমেয়ের কাছ থেকে যে-টাকা কম আদায় হবে, অন্য ছাত্রছাত্রীদের ফি বাড়িয়ে সেই ঘাটতি পুষিয়ে নিতে হবে। এ-সব জেনেও পুলিশ পরিবারের বাইরের অভিভাবকেরা তাঁদের ছেলেমেয়েকে কেন ওই স্কুলে ভর্তি করবেন, প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, যৌথ প্রকল্পেও লাভের জন্যই কোনও বেসরকারি সংস্থা বিনিয়োগ করে। তারা তো আর দানছত্র খুলে বসেনি!
এই অবস্থায় মডেল স্কুল নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার মান বাঁচে কীসে?
মান বাঁচানোর জন্য ব্যারাকপুরের লাটবাগানে সরকারি সাহায্যে চলা পুলিশের একটি স্কুলকে দত্তক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নবান্ন। প্রশাসনের খবর, ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ এডুকেশন সোসাইটি’ নামে একটি সংস্থা গড়ে ওই স্কুলের দায়িত্ব নেবে পুলিশ। সেখানেই পুলিশের ছেলেমেয়ের জন্য আসন সংরক্ষণ এবং কম খরচে পড়ার ব্যবস্থা হবে। লাটবাগানের এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘এলাকায় ওই স্কুলের ভালই চাহিদা আছে। প্রতি বছরই আসনের চেয়ে বেশি আবেদনপত্র জমা পড়ে। স্কুল পরিচালন সমিতিতে পুলিশ ছাড়াও সদস্য হিসেবে অন্য পেশার লোকজন আছেন। এ বার সরকার যা সিদ্ধান্ত নেবে, সে-ভাবেই স্কুল চলবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy