Advertisement
০২ মে ২০২৪

মার খেয়ে কাজ বন্ধ, অরাজক ন্যাশনাল

ট্যাক্সিতে শোয়ানো এক কিশোরের নিথর দেহ। বৃহস্পতিবার দুপুরে হাসপাতালের গেট থেকে ট্যাক্সিটা বেরোচ্ছিল। সঙ্গে উদ্‌ভ্রান্ত পরিজনেরা। ট্যাংরার ওই কিশোরের কাকা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘‘ব্রট ডেড কথাটা লেখারও লোক নেই!’’

ধর্মঘটে বসেছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। নিজের স্যালাইনের বোতল তাই রোগীর নিজের হাতেই। বৃহস্পতিবার চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

ধর্মঘটে বসেছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। নিজের স্যালাইনের বোতল তাই রোগীর নিজের হাতেই। বৃহস্পতিবার চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৬ ০৪:১১
Share: Save:

ট্যাক্সিতে শোয়ানো এক কিশোরের নিথর দেহ।

বৃহস্পতিবার দুপুরে হাসপাতালের গেট থেকে ট্যাক্সিটা বেরোচ্ছিল। সঙ্গে উদ্‌ভ্রান্ত পরিজনেরা। ট্যাংরার ওই কিশোরের কাকা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘‘ব্রট ডেড কথাটা লেখারও লোক নেই!’’

কিছুক্ষণ বাদে এক মহিলাকে পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে দেখল হাসপাতালের গেটে দাঁড়ানো পুলিশ। এক বছরের বাচ্চা মেয়ে পয়সা গিলে ফেলেছে। হেঁচকি উঠছে। মিনিট দশেক দৌড়োদৌড়ি করে মা বুঝতে পারলেন, এখানে সময়ই নষ্ট। অগত্যা মেয়ে কোলে অন্য হাসপাতালের দিকে ছুট।

খণ্ডচিত্রগুলো কলকাতা তথা রাজ্যের অন্যতম এক সরকারি হাসপাতালের। পার্ক সার্কাসের চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। আশপাশের লোকজন বুধবার রাত থেকে যেখানে রোগী আনা বন্ধ করেছিলেন। কারণ তাঁরা জেনে গিয়েছিলেন, জুনিয়র ডাক্তারেরা কর্মবিরতি করছেন। কিন্তু দূরদূরান্তের মানুষ জানবেন কী করে?

কাজেই ট্যাক্সি বা অ্যাম্বুল্যান্সে চড়ে যাঁরা এ দিন চিকিৎসার আশায় ঢুকে পড়েছেন, তাঁদের ভোগান্তির অন্ত ছিল না। যেমন দুপুর দু’টো নাগাদ ঘোষণা হল, শুধু গাইনিতে ডাক্তার দেখানো যাবে। অনেকে পড়িমরি ছুটলেন। কেউ রোগিণীকে পাঁজাকোলা করে। বাকিরা বসে রইলেন হতাশ মুখে। তবে যাঁরা গিয়েছিলেন, ভিড়ে ধাক্কা খেয়ে তাঁদের অনেকে ফিরেও এলেন।

দৃশ্য দেখে হাসপাতালের আউটপোস্টে ডিউটিরত এক কনস্টেবল বলছিলেন, ‘‘মেনটেনান্সের জন্য কলকাতার সব শ্মশান মাসে এক দিন এক বেলা বন্ধ থাকে। আবার জুনিয়র ডাক্তারদের স্ট্রাইকের জন্য কোনও না কোনও সরকারি হাসপাতাল এখন মাসে চব্বিশ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে!’’

কটাক্ষ হলেও ব্যাপারটা সে রকমই। অরাজকতার চূড়ান্ত। জুনে এসএসকেএমে দেড় দিন আন্দোলন চলেছে। জুলাইয়ে ন্যাশনালে। আন্দোলনকারীরা দুষছেন পুলিশকে। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে মারমুখী জনতা ঢুকে ভাঙচুর চালাচ্ছে, ডাক্তারদের পেটাচ্ছে। সব হয়ে যাওয়ার পরে পুলিশ আসছে। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার আশ্বাস দিচ্ছেন। কর্মবিরতি উঠছে। কিন্তু মাসখানেক বাদে একই ছবি, হয়তো অন্য কোথাও।

এ দিন সন্ধ্যায় যেমন নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে ন্যাশনালের জুনিয়র ডাক্তারেরা কর্মবিরতি তুলেছেন। তবে রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তাদের কেউ বুক ঠুকে বলতে পারছেন না যে, আর কোথাও এমন হবে না। বরং তাঁদের গলায় অসহায়তারই সুর। ‘‘নিরাপত্তা বাড়ানো হবে ঠিকই। কিন্তু পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ করে তো হাসপাতাল চালানো যায় না!’’— বলছেন এক কর্তা।

ন্যাশনালে কর্মবিরতি হল কেন?

হাসপাতাল সূত্রের খবর: এক রোগীর মৃত্যুতে বুধবার রাতে উত্তেজনা ছড়ায়। অভিযোগ, মৃতের পরিজনেরা এক জুনিয়র ডাক্তারকে বেদম পেটান। গৌরীশঙ্কর মহাপাত্র নামে ওই ডাক্তারকে আইটিইউয়ে ভর্তি করতে হয়।

এবং এর জেরে রাতেই কাজ বন্ধ করে দেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। অভিযোগ তোলেন, ইমার্জেন্সি থেকে শুরু করে ওয়ার্ড— কোথাও তাঁদের নিরাপত্তা নেই। ‘‘রোগীর সঙ্গে যত জন খুশি বাইরের লোক ভিতরে ঢুকে পড়ছে। তার পরে সামান্য এ-দিক ও-দিক হলেই ডাক্তারদের উপরে চড়াও হচ্ছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।’’— মন্তব্য এক জুনিয়রের। ন্যাশনালের ইমার্জেন্সির এক মেডিক্যাল অফিসারের অনুযোগ, ‘‘এখানে ইমার্জেন্সিতে অধিকাংশ রোগীর সঙ্গে গোটা পাড়া চলে আসে। গোড়া থেকেই তাদের মেজাজ সপ্তমে চড়ে থাকে। এ দিকে সিকিওরিটিতে বেশির ভাগ রিটায়ার্ড লোকজন। বয়স হয়েছে। মার খাওয়ার ভয়ে তাঁরা কাউকে আটকান না। পুলিশও সময় বুঝে উধাও হয়ে যায়।’’ ডাক্তাররা জানাচ্ছেন, ভিজিটিং আওয়ার্সে একটা কার্ড নিয়ে দশ-বারো জন ওয়ার্ডে ঢুকে পড়ছে, এটা এখানে চেনা দৃশ্য। ভয়ের চোটে গেটের নিরাপত্তাকর্মীরা কাউকে আটকান না। উপরন্তু ভিজিটিং আওয়ার্সের পরেও বহু লোক বহাল তবিয়তে ওয়ার্ডে রয়ে যায়।

বস্তুত রাজ্যের প্রায় সব মেডিক্যাল কলেজেই এমন সব অভিযোগ অহরহ শোনা যায়। সরকারি হাসপাতালগুলোর যা অবস্থা, তাতে কি বহিরাগত ঠেকানো আদৌ সম্ভব?

কলকাতার অন্যতম মেডিক্যাল কলেজ এনআরএসের এক প্রবীণ চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণ, ‘‘প্রত্যেক হাসপাতালে কর্মীর অভাব। ট্রলি জোগাড় করে রোগীকে তুলে ঠেলে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া কিংবা ওয়ার্ডে স্যালাইনের নল ঠিক করা— সব কিছুই বাড়ির লোককে করতে হয়। বাইরের লোক না-ঢুকলে হাসপাতালই তো বন্ধ হয়ে যাবে।’’

এমতাবস্থায় জুনিয়রদের কী বক্তব্য? ন্যাশনালের জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে সৌরভ সাহার জবাব, ‘‘আমরা চাই, হাসপাতালে পুলিশের সংখ্যা বাড়ুক। আর রোগীর সঙ্গে ভিতরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হোক শুধু এক জনকে। ভিতরে ঢোকানোর আগে তার পোশাক তল্লাশি করতে হবে। কারণ, ছুরি নিয়ে ওয়ার্ডে ঢোকার নজিরও এখানে মজুত।’’ রাতে ন্যাশনালের সুপার পীতবরণ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। আমরাই ঠিক করে দেব, কে কোথায় থাকবেন। কারণ, স্পর্শকাতর জায়গাগুলো আমরা জানি।’’

স্বাস্থ্য ভবনের ভূমিকা কী?

পর পর কর্মবিরতির ধাক্কায় হতাশ স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘‘আর কত পুলিশ থাকবে? হাসপাতাল কি শেষমেশ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে? বুঝতে পারছি না, আমরা আর কী করতে পারি।’’— আক্ষেপ সুশান্তবাবুর। তাঁর দাবি, ‘‘পুলিশকে অনুরোধ করেছি, মারধরের ঘটনায় যেন ঠিকঠাক ধরপাকড় হয়। অভিযুক্তদের যেন জামিন-অযোগ্য ধারা দেওয়া হয়। দু’জন ধরাও পড়েছে। কিন্তু এর পরে কী, সে ব্যাপারে আমরা নিজেরাও নিশ্চিত নই।’’

ন্যাশনালে বুধবারের ডাক্তার নিগ্রহের সূত্রে মৃতের দুই আত্মীয়কে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। ধৃতদের নাম মহম্মদ সরফরোজ ও শাবানা খাতুন। এ দিন তাদের শিয়ালদহ কোর্টে পেশ করা হয়। দু’জনকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত জেল হেফাজতে রাখার হুকুম হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

National Medical Junior doctor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE