হরিয়ানা সরকারের ব্যবহার করা চটের বস্তা উদ্ধার হল তেলঙ্গানার আদিলাবাদের গুদামে। ওগুলো ফের বিক্রির তোড়জোড় চলছিল।
গত বছরের কথা। ২৭ জুনে কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রকের ওই অভিযানের পরে জনৈক ধরমচাঁদ সতীশকুমারের নামে আদিলাবাদের জৈনাথ থানায় এফআইআর হয়। ভারতীয় দণ্ডবিধি ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য-আইনে মামলা রুজু হয়েছে। সতীশের কোম্পানির লেনদেনের নথিতে ধরা পড়ে, হরিয়ানার বস্তা আসলে বিক্রি করা হয়েছিল কলকাতার এক চটকলকে। মাঝ পথে টেনে ঢোকানো হয়েছে আদিলাবাদের গুদামে।
বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে তদন্তভার সিবিআই-কে দিয়েছে দিল্লি। আবার এ বছরের অগস্টে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ায় অভিযান চালিয়ে মন্ত্রকের টিম যা দেখেছে, তা-ও সমান উদ্বেগজনক। কী রকম?
হরিয়ানা-পঞ্জাব থেকে আসা খালি চটের বস্তা মজুত করা হয়েছিল ঘুসুড়ির এক গুদামে। ৬ অগস্ট সেগুলো উদ্ধার করা হয়। বস্তায় প্রস্তুতকারী সংস্থার নাম নেই। শুধু লাল-নীল দাগ। গুদামের মালিককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, ব্যবহৃত বস্তাগুলো আনা হয়েছিল চটকলে সরবরাহের উদ্দেশ্যে। অভিযোগ দাখিল হয়েছে বেলুড় থানায়।
দু’টো ঘটনা প্রতীকী। বিভিন্ন রাজ্যের কাছ থেকে মন্ত্রকের কাছে এমন বহু অভিযোগই এসেছে ও আসছে। যার মোদ্দা কথা— খাদ্যশস্য মজুতের চটের ব্যাগ সব নিম্ন মানের। ফলে প্রচুর শস্য নষ্ট হচ্ছে। মন্ত্রকের তদন্তে প্রকাশ, অধিকাংশ বস্তার গায়ে প্রস্তুতকারক সংস্থার নাম নেই। অথচ চটকল প্রথমে তা বেচেছে কোনও সরকারি সংস্থাকে। তা ঘুরে এসেছে চটকলেরই হাতে, ফের বিক্রির লক্ষ্যে। ‘‘দ্বিতীয় বার বিকোনো বস্তার মান কহতব্য নয়।’’— মন্তব্য এক কর্তার।
বস্তুত দেশ জুড়ে চট-কারবারের নিয়ন্ত্রক যারা, সেই বস্ত্র মন্ত্রকের তদন্ত-রিপোর্টেই ‘কেঁচো খুঁড়তে কেউটে’ বেরনোর উপক্রম। তাতে বিস্তারিত বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় পাটজাত পণ্য সংরক্ষণের নীতিকে কী ভাবে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিভিন্ন চটকল অসাধু ব্যবসা চালিয়ে অন্যায্য মুনাফা লুটছে। মন্ত্রকের পর্যবেক্ষণ— একের পর এক চটকলের ঝাঁপ ফেলার পিছনে মূল কারণ এই দুর্নীতি। পাটের চাহিদা হ্রাসের বিষয়টি আসছে পরে। দুর্নীতির চেহারাটা কী?
পাট-আইন অনুযায়ী মন্ত্রক স্থির করে দেয়, বিভিন্ন পণ্যের কতটা অংশ চটের বস্তা দিয়ে প্যাকিং করতে হবে। যেমন, ৯০% খাদ্যশস্য ও ২০% চিনি চটের বস্তায় ভরা আবশ্যিক। দিল্লির যুক্তি: এতে যেমন চাষিদের ফলানো পাটের চাহিদা থাকবে, তেমন চটকল শ্রমিকেরা কাজ পাবেন। মন্ত্রকের তথ্য বলছে, ২০০৬-০৭ অর্থবর্ষে কেন্দ্র জুটমিল থেকে ৪ লক্ষ টন চটের বস্তা কিনেছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে পরিমাণটা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৩ লক্ষ টন।
তবু চটকল রুগ্ণ হচ্ছে কেন?
প্রশ্নটা তুলে উত্তরও দিয়েছে মন্ত্রকের রিপোর্ট। আঙুল উঠেছে মূলত দু’টো কারণের দিকে। এক, বিক্রি করা নতুন বস্তা ব্যবহার হয়ে ফেরত আসছে চটকলেই। এবং আবার বিক্রি হচ্ছে। পুরো চক্রের নেপথ্যে প্রশাসন ও ব্যবসায়ীদের একাংশের আঁতাত রয়েছে বলে অভিযোগ। ‘‘অর্থাৎ কম দামে কেনা হাতফেরতা বস্তা বেচে লাভ করার চেষ্টা। এতে মালিকদের নতুন উৎপাদনের তাগিদ কমছে। মিল রুগ্ণ হয়ে পড়ছে।’’— ব্যাখ্যা এক কর্তার।
দ্বিতীয় কারণ— দেশের চাষিদের থেকে পাট না কিনে অনেক মিল-মালিক বাইরে থেকে ‘রেডিমেড’ বস্তা কিনে নিচ্ছেন, বিস্তর কম দামে। নেপালের অন্তত চারটি চটকলের নাম উল্লেখ করে রিপোর্টের দাবি: ওরা মূলত ভারতের বাজারের জন্যই বস্তা বানায়। মিলগুলো তা কেনে টনপিছু ৮১ হাজার টাকায়, সরকারকে বেচে অন্তত ৯৩ হাজারে। বহু জুটমিল আবার সস্তার বাংলাদেশি কাঁচা পাট আমদানি করে লাভের বহর বাড়াচ্ছে।
প্রতিরোধের উপায় নেই?
মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, এমন সুকৌশলে দুর্নীতি চলছে যে, জড়িতদের চিহ্নিত করা মুশকিল। তবে পশ্চিমবঙ্গের দু’টি জুটমিলের বিরুদ্ধে পাকা প্রমাণ মিলেছে বলে ওঁদের দাবি। ‘‘চটের বস্তা কিনতে কেন্দ্র বছরে পাঁচ-ছ’হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। যাতে পাটচাষিরা দাম পান, শ্রমিকদের কাজ জোটে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক শ্রেণির কেন্দ্রীয় কর্তার যোগসাজশ পুরো উদ্যোগে জল ঢেলে দিচ্ছে।’’— আক্ষেপ এক কর্তার।
জুটমিল-মালিকেরা অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, মাঝে-মধ্যে বস্তা আমদানি হলেও পরিমাণ নগণ্য। রিপোর্টে অভিযুক্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক জুটমিলের কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘‘আমরা কখনওই সরকারকে আমদানি করা বস্তা বিক্রি করিনি।’’
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy