Advertisement
E-Paper

অ্যাসিড না আগুন, ধন্দে পুলিশ

গাছগাছালিতে ভরা এক চিলতে গ্রামটা থম মেরে আছে শনিবার রাত থেকেই। পাড়ার মোড়ে জটলা আছে। মাচায় ভিড় আছে। খেতে কাজও করছেন লোকজন। তবে সবাই যেন বড় বেশি চুপচাপ। তেহট্টের বেতাই জুড়ে শোকের আবহ। একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তামাম গ্রাম জুড়ে—আগুন না অ্যাসিড?

কল্লোল প্রামাণিক ও সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৬ ০১:৪৬
গেটের ওপাশেই অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় পড়েছিলেন তরুণী। ডান দিকে, কৃষ্ণনগর হাসপাতালে তদন্তে পুলিশ।— নিজস্ব চিত্র

গেটের ওপাশেই অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় পড়েছিলেন তরুণী। ডান দিকে, কৃষ্ণনগর হাসপাতালে তদন্তে পুলিশ।— নিজস্ব চিত্র

গাছগাছালিতে ভরা এক চিলতে গ্রামটা থম মেরে আছে শনিবার রাত থেকেই। পাড়ার মোড়ে জটলা আছে। মাচায় ভিড় আছে। খেতে কাজও করছেন লোকজন। তবে সবাই যেন বড় বেশি চুপচাপ। তেহট্টের বেতাই জুড়ে শোকের আবহ। একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তামাম গ্রাম জুড়ে—আগুন না অ্যাসিড? কী ভাবে মৃত্যু হল মূক ও বধির মেয়েটার?

বেতাইয়ে করিমপুর-কৃষ্ণনগর রাজ্যসড়ক থেকে বেশ কিছুটা এগোলে একটি দোতলা বাড়ি। শনিবার রাতে সেই বাড়ির একতলার বারান্দায় যন্ত্রনায় ছটফট করছিলেন বছর ত্রিশের ওই তরুণী। তাঁর গোঙানি শুনে ছুটে আসেন তাঁর ভাই ও পড়শিরা। প্রথমে তেহট্ট মহকুমা হাসপাতাল ও পরে নিয়ে যাওয়া হয় শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে। রবিবার দুপুরে সেখানেই মারা যান ওই তরুণী।

তরুণীর ভাই ও পরিবারের অভিযোগ, দুষ্কৃতীদের ছোড়া অ্যাসিডেই এমন অঘটন। তবে পুলিশ ও চিকিৎসকদের দাবি, অ্যাসিড নয়, অগ্নিদগ্ধ হয়েই মারা গিয়েছেন ওই তরুণী। শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক অম্লান পাল চৌধুরী বলেন, ‘‘দেহের আশি শতাংশ পুড়ে গিয়েছে। অ্যাসিডে কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা নয়।’’

পুলিশের দাবি, ঘটনাস্থলে অ্যাসিডেরও কোনও প্রমাণ মেলেনি। জেলা পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া বলছেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে অগ্নিদগ্ধ হয়েই মারা গিয়েছেন ওই তরুণী। তবে কী ভাবে আগুল লাগল তা স্পষ্ট নয়। প্রয়োজনে ফরেন্সিক দলের সাহায্য নেওয়া হবে।’’ পুলিশ এ দিন ওই তরুণীর পোড়া পোশাক উদ্ধার করেছে।

তবে এ দিনের ঘটনার পরে পুলিশের কাছে স্থানীয় বাসিন্দা সুধীর বিশ্বাস-সহ চার জনের বিরুদ্ধে থানায় খুনের মামলা রুজু করেছেন ওই তরুণীর কাকা। সুধীর বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ অবশ্য এই প্রথম নয়। গত ৫ জুলাই মূক ও বধির ওই তরুণীকে সুধীর ধর্ষণ করেছে বলে মৃতার ভাই ১২ জুলাই পুলিশের কাছে অভিযোগ জানান।

মৃতার ভাই জানান, ঘটনার পরে প্রথমেই তাঁরা থানা-পুলিশ করতে চাননি। গ্রামেই বসেছিল সালিশি সভা। সেখানে ঠিক হয়, তরুণীর পরিবারকে নগদ চল্লিশ হাজার টাকা ও তিন কাঠা জমি দিতে হবে সুধীরকে। দুই পক্ষই ওই প্রস্তাবে রাজি হয়। কিন্তু ১২ জুলাই বাড়ি থেকে বেপাত্তা হয়ে যান সুধীর।

পুলিশ জানিয়েছে, তারপরেই ওই তরুণীর দাদা থানায় এসে অভিযোগ দায়ের করেন। তবে পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলে মৃতার ভাইয়ের অভিযোগ, পুলিশ তেমন কোনও পদক্ষেপ করেনি। উল্টে থানা থেকে ‘কেস’ না তুলে নিলে তাঁর দিদিকে মেরে ফেলা হবে বলেও শাসানো হচ্ছিল। ওই যুবকের কথায়, ‘‘কিন্তু সত্যিই যে ওরা দিদিকে মেরে ফেলবে তা ভাবতেই পারিনি।’’

ওই সালিশি সভায় উপস্থিত ছিলেন বেতাই ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য মনোরঞ্জন বালা ও তৃণমূলের আর এক মহিলা সদস্যের স্বামী গণেশ গাইন। মনোরঞ্জনবাবু কিছু না বলতে চাইলেও গণেশ গাইন বলেন, “অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত দুই পরিবারের ডাকে ওই সালিশি সভায় গিয়েছিলাম। সেখানেই টাকা ও জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন সকলেই। তারপরেই তো এই ঘটনা। পুলিশ ভাল ভাবে তদন্ত করলেই আসল তথ্য বেরিয়ে আসবে।”

কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে বেশ কিছু প্রশ্ন ভাবাচ্ছে পুলিশকে। জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, মৃতার ভাইয়ের দাবি, তিনি নিজে তাঁর দিদিকে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় দেখেছেন। আবার তিনিই অভিযোগ করেছেন, অ্যাসিড ছুড়ে ওই তরুণীকে খুন করা হয়েছে। অথচ যে ঘরে ওই তরুণী ছিলেন সেই ঘরের দরজা-জানালা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। বাইরের গ্রিলেও তালা মারা ছিল। ফলে অ্যাসিড কী ভাবে ছোড়া হল তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে। অন্য দিকে, ঘটনাস্থলে অ্যাসিডের কোনও নমুনা মেলেনি। আবার অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটলেও কেরোসিন কিংবা পেট্রোলের কোনও নমুনা বা গন্ধ এখনও পর্যন্ত কোনওটাই পাওয়া যায়নি।

ওই তরুণী কি কিছু বলতে পেরেছিলেন?

পুলিশ সুপার জানাচ্ছে‌ন, মূক ও বধিরদের ইঙ্গিত যাঁরা বুঝতে তপারেন তেমনই এক বিশেষজ্ঞকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবে তিনি আসার কিছুক্ষণ আগেই মারা যান ওই তরুণী। তাই তাঁর কাছ থেকে তেমন কোনও তথ্য মেলেনি। পুলিশ জানাচ্ছে, এই ঘটনায় কাউকেই সন্দেহের বাইরে রাখা হচ্ছে না। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলেই অনেক বিষয় স্পষ্ট হবে। জেলার সমাজকল্যাণ আধিকারিক সুব্রত দাস বলেন, ‘‘মূক ও বধিরকে সফ্‌ট টার্গেট করা হয় কারণ, ওঁরা অনেক সময় বোঝাতে পারেন না ঠিক কী ঘটেছে। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগায় দুষ্কৃতীরা।’’

এ দিন ওই তরুণীর মৃত্যুর পরে কান্নায় ভেঙে পড়েন পড়শিরা। তাঁদের একজনের কথায়, ‘‘ছোট থেকেই মেয়েটা কথা বলতে পারেনা। কানেও কিছু শুনত না। বাবা-মা মারা গিয়েছে সেই কবে। আমরাই ওদের দুই ভাইবোনকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। সেই মেয়েটা যে এ ভাবে চলে যাবে তা ভাবতেই পারছি না।’’

Building Police
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy