Advertisement
১১ মে ২০২৪
উল্টো অক্ষরের পাতাই গড়গড় করে পড়ছেন সন্তোষকুমার ঘোষ। নিউজ় ডেস্কে বসে কবিতা লিখে দিচ্ছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। আসর জমাচ্ছেন হিমানীশ গোস্বামী। সোনাঝরা অতীত।
ABP Centenary

ভরা অশেষের ধনে

উল্টো অক্ষরের পাতাই গড়গড় করে পড়ছেন সন্তোষকুমার ঘোষ। নিউজ় ডেস্কে বসে কবিতা লিখে দিচ্ছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। আসর জমাচ্ছেন হিমানীশ গোস্বামী। সোনাঝরা অতীত।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২১ ০০:৫৯
Share: Save:

লাইনোটাইপ থেকে আমাদের কাগজ, আনন্দবাজার পত্রিকা, যখন সদ্য পিটিএস-এ গিয়েছে, তখন দু’টি বাংলা টাইপ-রাইটার এল রিপোর্টিং বিভাগে। আমরা সবাই সেই সময় লিখতাম প্যাডে। বিভাগে সবচেয়ে নবীন বলে আমাদের দু’তিন জনের উপর নির্দেশ এল, আর হাতে লেখা চলবে না। নতুনদের টাইপ করে লেখা জমা দিতে হবে। টাইপ করার অভিজ্ঞতা আমাদের কারও ছিল না। বাংলা টাইপ তো আরও দূরের কথা!

তখন বার্তা সম্পাদক ছিলেন বিজয় চক্রবর্তী। তাঁকে গিয়ে ধরলাম, “এক লাইন টাইপ করতেই নাজেহাল। এমন হলে তো কপি লেখা অসম্ভব! আপনি একটু আমাদের দিকটা দেখুন!”

যে কোনও যুক্তির যুদ্ধে বিজয়দা ছিলেন কার্যত অপ্রতিরোধ্য। চাইলে কোনও তুচ্ছ বিষয়কে কথার মারপ্যাঁচে গুরুতর করে তোলা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে নস্যাৎ করে দেওয়ার অননুকরণীয় এক কায়দা ছিল তাঁর। কিন্তু ভিতরে বয়ে যেত স্নেহ-প্রশ্রয়ের ফল্গুধারা। অতএব প্রথম রাউন্ডে হেরে যেতে হল। তার পরে এল সমাধানসূত্র— দিনের লেখা হাতে লিখলেও বিশেষ লেখা বা উত্তর-সম্পাদকীয় টাইপ করেই জমা দিতে হবে। না হলে সেই লেখা ছাপা হবে না।

সেটা ‘ম্যানেজ’ করতে অবশ্য খুব অসুবিধে হয়নি। ক্রমশ টাইপ-রাইটার দু’টিতে ধুলো জমল। সিগারেটের ছাই ছড়াল। অবশেষে সেগুলি সরে গেল।

ঘটনাটি হয়তো সামান্য। অনেকের মনে হতে পারে, মজার গল্প। সে দিন সত্যিই বুঝিনি। এখন বুঝি, প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে বিশেষ করে নতুনদের অভ্যস্ত করে তোলা জরুরি ছিল বলেই অনেক আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃপক্ষ। একটি প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়ন-ভাবনার এটি এক খণ্ডচিত্র।

আজকের ব্যবস্থায় কম্পিউটার ছাড়া লেখার বা কাজের উপায় নেই। শিখে নিতে হয় সকলকে। ফলে আমরাও শিখেছি। অথচ এক সময় টাইপটুকু শিখতে চাইনি। দিল্লি অফিসে যখন প্রথম ‘মোডেম’ বসল, অভ্যস্ত নই বলে টাইপ করে লেখা পাঠাতে পারতাম না। যাঁরা নতুন পদ্ধতি শিখতে দেরি করেননি, তাঁরা পারতেন। এমনকি প্রবীণ বয়সে গৌরকিশোর ঘোষও অদম্য উৎসাহে বাংলা টাইপ-রাইটারে সড়গড় হয়েছিলেন। এটাই জীবনের এক শিক্ষা।

অন্তহীন চলমানতার বাঁকে বাঁকে বদলে যাওয়ার অজস্র বাঙ্ময় উপস্থিতি এই ভাবে আমাদের সমৃদ্ধ করেছে এখানে। আজও করে। প্রতিটি বাঁক উত্তরণের এক একটি সোপান চিনিয়ে দেয়। উপরে এবং আরও উপরে ওঠার পথে যেতে যেতে মাইলফলকগুলি ইতিহাসের কাহিনি শোনায়। আমরা বুঝতে পারি, সময়ের দাবি অনুযায়ী পরিবর্তন কত প্রয়োজনীয়। তবে তা অতীতকে অস্বীকার করার ঔদ্ধত্যে নয়, বরং তাকে প্রেরণার উৎস হিসেবে মান্যতা দিয়ে।

আনন্দবাজার পত্রিকায় আমার যাত্রা শুরু এক পরম সন্ধিলগ্নে। ১৯৮০-র গোড়ার কথা। পুরনো প্রযুক্তি থেকে এই সংবাদপত্র তখন ক্রমশ নতুন প্রযুক্তির দিকে যাচ্ছে। নিউজ়রুম সেই আমলে ছিল নারী-বর্জিত। যদিও অচিরে সেই ভেদরেখাও উঠে যায়। তার পর থেকে সাংবাদিক হিসেবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে চলেছেন সবাই। অনেক মহিলা-সাংবাদিক আজ এখানে বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে আসীন। এ ক্ষেত্রেও আনন্দবাজার পত্রিকা নামক প্রতিষ্ঠান সম্ভবত অগ্রণী।

এখানে শিক্ষানবিশ সাংবাদিক পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া দীর্ঘ কাল ধরে একেবারে পেশাদারি। নির্দিষ্ট মানের ভিত্তিতে লিখিত পরীক্ষায় ডাকা হয়। উত্তীর্ণ হলে মুখোমুখি কথা এবং সেই ধাপ পেরোলে শিক্ষানবিশ হওয়ার সুযোগ। কাজের যোগ্য বিবেচিত হলে তবেই পাকা চাকরি। আমাদেরও এই ভাবে চাকরি পেতে হয়েছে। আগেই বলেছি, মূল উদ্দেশ্য হল, প্রযুক্তি এবং মানবসম্পদ উভয়কে সমভাবে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে চলা। তাই আজ শতবর্ষে পৌঁছেও আনন্দবাজার পত্রিকার তারুণ্য অম্লান।

আমরা যখন চাকরিতে এসেছি, তখন লেটারপ্রেস তার অন্তিম পর্বে। এর পরেই দ্রুত এল ফোটো টাইপ সেটিং (পিটিএস)— ব্রোমাইড প্রিন্ট থেকে পাতার ছবি তুলে সেই ফিল্মের প্লেট তৈরি করে ছাপা। ক্রমশ প্রযুক্তির আধুনিকতার অধ্যায়ে আজ লেখা থেকে ছাপা, সব কিছুই কম্পিউটার-নির্ভর।

অনেকেই জানেন, আগে লাইনো মেশিনে টগবগিয়ে ফুটতে থাকা সিসা (হট মেটাল) থেকে হত অক্ষর নির্মাণ। তবে কম্পোজ়ে সব উল্টো, ছাপা হলে তবে সোজা। ‘উল্টো’ পাতা গড়গড়িয়ে পড়ে ফেলতেন নিউজ় ডেস্কের সিনিয়র দাদারা অনেকেই। আর উল্টো-পড়ার দক্ষতায় তাঁদের দশ গোলে হারিয়ে দিতেন প্রেসের সহকর্মীরা।

সিসার অক্ষরে সাজানো ভারী ভারী পাতাগুলিকে যেখানে রেখে বাঁধা হত, তার নাম স্টোন। দু’এক বার গভীর রাতে সন্তোষকুমার ঘোষকেও দেখেছি সেখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট হাতে অনায়াসে ‘উল্টো’ লেখা পড়তে পড়তে নির্দেশ দিচ্ছেন, “এখান থেকে এই চারটে লাইন ফেলে দাও।” পাশে কম্পোজ়িটরকে মুখে বলে চলেছেন সংশোধিত লাইনগুলি। সেখান থেকে নতুন লাইন তৈরি করে তুলে এনে বসানো হচ্ছে নির্মীয়মাণ পাতায়।

এ সব অবশ্য রাতে কাগজ ছাপার সময়ের চিত্র। কিন্তু প্রেসে লেখা পাঠানো তো সারা দিনের কাজ। নিউজ় রুম থেকে অবিরাম খবর লেখা হয়ে চলে যাচ্ছে নীচে কম্পোজ় করার জায়গায়।

খুব মজাদার ব্যবস্থা ছিল তার। বার বার উপর-নীচ করার ঝক্কি এড়াতে নিউজ় রুমের এক প্রান্তে ছিল কপিকল-পদ্ধতি। লিফটের মতো উপর থেকে সুইচ টিপলে প্রেস থেকে একটি বাস্কেট উঠে আসত। ঘুলঘুলির মতো একটি ফোকর ছিল। সেখানে হাত গলিয়ে লেখা পাতাগুলি বাস্কেটে ভরে সুইচ টিপে দিলেই সে নেমে যেত সরসরিয়ে। একই ভাবে লেখার প্রুফ (বলা হত, ন্যারো) চলে আসত নিউজ় রুমে।

ঐতিহ্য: আনন্দবাজার পত্রিকার পুরনো ভবন। বাঁ দিকে, কর্মরত ছাপাখানার কর্মীরা

ঐতিহ্য: আনন্দবাজার পত্রিকার পুরনো ভবন। বাঁ দিকে, কর্মরত ছাপাখানার কর্মীরা

সাংবাদিকতাই হোক, বা সাহিত্য— আনন্দবাজার পত্রিকা বরাবরই সারস্বত সাধনার পীঠ। কর্মসূত্রে এখানে যাঁদের প্রথম কাছ থেকে দেখেছি, যাঁদের সঙ্গে একই ঘরে বা কাছাকাছি বসে কাজ করার সুযোগ হয়েছে, তাঁদের অনেকেই আজ প্রয়াত। সন্তোষকুমার ঘোষ, গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্ত নেই। চলে গিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মতো আরও অনেকে। কিন্তু এই সব আলোকশিখা নেওয়ার নয়। কর্মক্ষেত্রে তাঁদের ঘিরে ছোট-বড় বিবিধ স্মৃতিও তাই অমলিন। সেই সঙ্গেই পেয়েছি নানা শিক্ষা।

যখন জুনিয়র রিপোর্টার, তখন সন্তোষদার ঘরে তাঁর লেখার ডিকটেশন নিতে ডাক পেতাম। কখনও সম্পাদকীয়, কখনও গল্প-উপন্যাস। দেখতাম, লেখার প্রথম লাইনটি লিখতে কত সময় নিতেন তিনি। বার বার লেখা, আর পাতা ছিঁড়ে ফেলা। বলতেন, “লেখার প্রথম দু’একটি বাক্য ভেবে লিখতে হয়। সেখান থেকে বাকি লেখা এগিয়ে যায়।”

গৌরদার উপদেশ ছিল, ‘দেখার চোখ’। তিনি বোঝাতেন, “যখন যেখানে যাবি, চেষ্টা করবি অন্য রকম কিছু একটা খুঁজে নিতে। দেখবি সেটাই হতে পারে তোর লেখার স্ট্রং পয়েন্ট।” এ সব পুরনো হয় না।

রাজনীতির খবর করার সূত্রে বরুণদা ছিলেন আরও কাছের। নিত্য দিন বিভিন্ন পার্টি অফিস ঘুরে এসে তাঁর কাছে আগে সব বলতাম। প্রায়ই নিজের লেখা হাতে দিয়ে তিনি হেসে বলতেন, “আমি তো টেনেটুনে পাশ! একটু বানান-টানানগুলো দেখে ঠিক করে দিয়ো তো…।” বুঝতাম, ঝরঝরে ভাষায় রাজনীতির কচকচিকে কী ভাবে সাধারণের কাছে পরিবেশন করা যায়, তিনি আসলে সেটাই শেখাচ্ছেন।

যেমন, কোনও প্যাঁচালো খবর ‘আইন বাঁচিয়ে’ লেখার শিক্ষা অনেকটাই পেয়েছি বিধান সিংহের (এক সময় চিফ রিপোর্টার) কাছে। কোথায় ‘কার্যত’ লেখা উচিত, আর কোথায় ‘প্রসঙ্গত’, তার সঙ্গত বিধান তিনি দিতেন সব সময়।

শেখার দৃষ্টান্ত অজস্র। বস্তুত সব সিনিয়রই এখানে কোনও না কোনও ভাবে ‘শিক্ষক’ হয়ে উঠে পরবর্তীদের এগিয়ে দিতে তৈরি থাকেন। কাজ করতে বেরিয়ে অগ্রজ চিত্রসাংবাদিকদের কাছেও আমরা অনেক কিছু শিখেছি! একটি চলমান প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এগুলি কম গৌরবের নয়। এ ভাবেই বজায় থাকে ধারাবাহিকতা।

কালের নিয়মে অবশ্য সাংবাদিকতার ধারা বদলেছে। টিভি-সাংবাদিকতার প্রসারের ফলে খবর লেখার ধরনও বদলে নিতে হচ্ছে। সবই ঠিক। কিন্তু মূলগত অবস্থানে আনন্দবাজার পত্রিকা ধারাবাহিকতার অনুসারী বলেই ঐতিহ্য, পরম্পরা এবং যুগোপযোগিতার মেলবন্ধন অবিচ্ছেদ্য।

আমরা জানি, সাহিত্য এবং সাংবাদিকতার ভেদরেখা বিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকাকে বারংবার নানা রকম প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়। সেই তাত্ত্বিক আলোচনা এই পরিসরে করার নয়। শুধু এটা বলব, প্রতিষ্ঠিত লেখক-কবিরা এই সংবাদপত্রের বার্তা বিভাগে সাংবাদিকের দায়িত্ব পালনে কখনও অসফল হননি। বরং খবর লেখার গুণমান তাতে বেড়েছে। আর সংবাদ পরিবেশনের ভাষায় যিনি আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছেন, সেই সন্তোষকুমার ঘোষ লেখকও ছিলেন।

আমরা চাকরির প্রথম দিকে শীর্ষেন্দুদা (মুখোপাধ্যায়)-কে নিউজ় ডেস্কে বসে খবর নিয়ে কাজ করতে দেখেছি। আবার তার ফাঁকেই প্যাড টেনে ‘দেশ’ পত্রিকায় চলতি ধারাবাহিকের কিস্তিও তাঁকে লিখতে দেখেছি ওই টেবিলে বসেই। মজা করে বলেছেন, “কাল জমা না দিলে সাগরদা (পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ) আমার মাথা ভাঙবেন।” অবাক বিস্ময়ে ভাবতাম, এক জন ব্যক্তি আমেরিকা-উগান্ডা-নিকারাগুয়া অথবা ইরাক-ইরান যুদ্ধের খবর লিখে পরমুহূর্তেই কেমন করে দূরবীন বা মানবজমিন-এ ফিরে যেতে পারেন! ভাবনার কোনও ছন্দপতন নেই।

‘সহজবোধ্য’ কারণে শক্তিদাকে কাগজের নাইট ডিউটিতে আমরা বড় একটা দেখিনি। সাধারণত দুপুরের দিকে এসে সন্ধের আগে চলে যেতেন। আসলে শক্তিদা মানে ব্যতিক্রম। তবে যত ক্ষণ থাকতেন, তিনিই মধ্যমণি। ‘মেজাজ-মর্জি’ হলে ডেস্কে বসে খবর লিখতেন। আবার ‘আজ এক্ষুণি লিখে দাও’ বলে সেখানে বসিয়েই তাঁর কাছ থেকে কবিতা আদায় করে নেওয়ার কথাও মনে আছে। পরে অবশ্য শক্তিদা, সুনীলদা, শীর্ষেন্দুদা প্রমুখ কবি-লেখক ‘দেশ’ পত্রিকায় বসতেন।

নিউজ় রুমের একটি প্রান্তে ছিল ক্রীড়া সাংবাদিকদের জায়গা। আমরা যখন চাকরিতে আসি, তখন মতিদা (নন্দী) ছিলেন ক্রীড়া সম্পাদক। বেশি রাতে তাঁর টেবিলও ছিল আর একটি আকর্ষণ। নাইট ডিউটিতে কাজ হালকা হয়ে গেলে নিউজ় ডেস্কে প্রায়ই সরস মজলিশ জমাতেন হিমানীশদা (গোস্বামী)। সিরাজদা (সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ) ছিলেন তুলনায় একটু গম্ভীর। তবে কখনও প্রসঙ্গ পেলে কম যেতেন না তিনিও। লেখক-কবি-সাংবাদিক সব সত্তা এ ভাবেই একাকার হয়ে থেকেছে। বেড়েছে সংবাদপত্রের মান।

এত ক্ষণ আলোচনা হল সাংবাদিকদের বৃত্তে। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানের অন্তর্নিহিত, অফুরান জীবনীশক্তি ছড়িয়ে থাকে তার প্রতিটি শিরা-উপশিরায়, প্রতিটি শাখায়। সেখানে কেউ আকবর বাদশা নন, কেউ হরিপদ কেরানিও নন। সকলে মিলে এক এবং সেটাই হল একমাত্র পরিচয়।

আমাদের চাকরিজীবনে আনন্দবাজার পত্রিকায় দু’টি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা দেখতে হয়েছে। একটি ৫১দিন অফিস বন্ধ হয়ে থাকা। অন্যটি বিধ্বংসী আগুনের গ্রাস। দুই ক্ষেত্রেই জয়ী হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্ঘবদ্ধ ঐক্য। তার শরিক হতে পারাও এক গৌরবময় অভিজ্ঞতা।

১৯৮৪-র ২৫ এপ্রিল অফিসের গেট আটকে যাঁরা বসে পড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের কর্মী মুষ্টিমেয়। পিছনে ছিল বাইরের রাজনৈতিক ও অন্য প্ররোচনা। ৫১দিন আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্য টেলিগ্রাফ কিছুই প্রকাশিত হয়নি। সাংবাদিক-অসাংবাদিক যুক্ত কমিটির উদ্যোগে পথে পথে জমায়েত করে আমাদের কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন বিশিষ্ট সাংবাদিকেরা।

অবশেষে আদালতের নির্দেশে আমরা যে দিন সবাই মিলে মিছিল করে নিজেদের কর্মস্থলে ফেরার সুযোগ পেলাম, সে দিন হল শারীরিক আক্রমণ। এই সব কথা খুব অজানা নয়।

যেটা বলার তা হল, ১৪ জুনের অভিজ্ঞতা। সেই সন্ধ্যায় দেড় মাসেরও বেশি বন্ধ পড়ে থাকা অন্ধকার অফিসে ঢুকে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল,
ওই রাতেই কাগজ তৈরি হবে এবং পর দিন পাঠকদের হাতে তা পৌঁছে দেওয়া হবে। সর্ব স্তরের কর্মীদের উৎসাহ, আন্তরিকতায় সেই উদ্দেশ্য সফল হল। সম্মিলিত ঐক্যে কী করে এই কঠিন কাজটি সম্ভব হয়েছিল, ভাবলে আজও গর্ব হয়। শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে।

১৫ জুন সকালে অল্প কয়েকটি পাতার আনন্দবাজার পত্রিকা বেরোয়। মূল খবরের শিরোনাম: ‘সশস্ত্র হামলা উপেক্ষা করে কর্মীরা আনন্দবাজারে ঢুকলেন: আহত ৩২’। যত দূর জানি, বাজারে সে দিনের আনন্দবাজার পেতে হাহাকার। প্রায় সিনেমার টিকিটের মতো চড়া দামে ব্ল্যাকে কাগজ বিকিয়েছিল।

এর পরের পর্ব আরও ভয়ানক। অফিসে কাজ করতে আসা কর্মীদের রাস্তায় আটকানো, শাসানি, চড়-চাপড়। সেটা চলেছিল আরও দিন কুড়ি। ফলে আমরা সকল কর্মী রাত-দিন অফিসকেই ঠিকানা করে নিলাম। এখানেই থাকা-খাওয়া এবং কাজ করা। সবার জন্য বলি, তখনকার প্রযুক্তিতে পাতার প্লেট তৈরি হয়ে যখন উল্টো দিকের বাড়িতে ছাপতে যেত, আমরা সবাই হাতে হাত ধরে মানববন্ধন গড়তাম। যাতে পথটুকু নিরাপদ হতে পারে।

আগুনের ঘটনা ১৯৯৯-তে। ভোরে খবর পেয়ে দলে দলে কর্মী অফিসের গেটে পৌঁছে যান। গিয়ে দেখি, লেলিহান শিখা। চেনা সাদা বাড়িটা ক্রমশ পুড়ে কালো হয়ে যাচ্ছে। খসে পড়ছে এক একটি অংশ। সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে করতে আজও শঙ্কা হয়।

শুধু গর্বের সঙ্গে বলব, প্রতিষ্ঠানের মূল ভবন যখন পুড়ছে, তখনই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সম্পাদকের কাছে আর্জি জানানো হয়— কাগজ বন্ধ করতে আমরা চাই না। যে ভাবে হোক, কাগজ বার করতে সবাই মানসিক ভাবে তৈরি। বিকল্প ব্যবস্থায় কাগজ বেরোল যথারীতি। আরও এক বার সম্মিলিত ঐক্য জয়ী হল।

নব কলেবরে প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের ৬ নম্বর বাড়িটি সেই শপথের ঠিকানা। শতবর্ষের আলোয় যা উজ্জ্বলতর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

History Newspaper ABP Centenary
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE