সংঘর্ষ থামাতে নেমেছে পুলিশের বাহিনী।
রেললাইনের ধারে কাছাকাছি দুই বস্তি।
এক সময়ে দু’টিতেই ছিল সার দেওয়া ঝুপড়ি। এখন একটিতে ঝুপড়ির সংখ্যা বেশি, অন্যটিতে ঝুপড়িবাসীরা ফ্ল্যাট পেয়েছেন।
মানিকতলা থানা এলাকার কাঁকুড়গাছিতে এই কৃষ্ণপল্লি ও নতুনপল্লি-র বেশির ভাগ বাসিন্দাই এখন শাসক দলের সমর্থক-কর্মী বলে পরিচিত। তবুও কোথাও যেন দুই পল্লির মধ্যে চাপা প্রতিযোগিতা, রেষারেষি। অনেকের মতে, যা মূলত ওই ফ্ল্যাট পাওয়া-না পাওয়া ঘিরেই।
এ নিয়ে অশান্তি ছিলই। প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায়, ‘সামান্য’ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সোমবার রাত থেকে ওই দুই পাড়ার রেষারেষি শুরু হয়। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত চলা সেই খণ্ডযুদ্ধের মাঝখানে পড়ে মার খায় পুলিশ। এমনকী, তাণ্ডবের আঁচে লাগোয়া রেললাইনে ট্রেন চলাচলও বিঘ্নিত হয়। যাত্রীদের সুরক্ষায় বসাতে হয় পাহারা। গোটা ঘটনার পিছনে তৃণমূলের ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের’ তত্ত্বের পাশাপাশি সিপিএমের ‘কারসাজি’র অভিযোগও উঠছে।
পুলিশ জানায়, ঘটনার সূত্রপাত সোমবার রাত ১১টায়। কৃষ্ণপল্লির বাসিন্দা বাবাই দাস নামে এক যুবক রুটি কিনতে গিয়ে বচসায় জড়িয়ে পড়েন নতুনপল্লির বাসিন্দা কমল গুপ্তের সঙ্গে। এক সময়ে দু’জনে একই গ্যারাজে কাজ করতেন। এখন গ্যারাজ ভাগ হয়ে যাওয়ায় দু’জনে আলাদা মালিকের অধীনে। সেখানেও রেষারেষি রয়েছে। তা ছাড়া, পল্লিগত ভাবেও রোষ রয়েছে। অভিযোগ, বাবাইকে একা পেয়ে শুধু গালিগালাজ নয়, মারধরও করেন কমল ও তাঁর দলবল। কমল ও তাঁর বন্ধুরা মত্ত ছিলেন বলেও অভিযোগ।
এলাকাটি কলকাতা পুরসভার ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে। পুলিশ জানায়, মার খেয়ে বাবাই নিজের পাড়ায় ফিরে গিয়ে লোকলস্কর নিয়ে আসেন। রাতেই রেললাইনের পাথরকুচি এবং কাচের বোতল হাতিয়ার করে শুরু হয়ে যায় ধুন্ধুমার সংঘর্ষ। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ আসেন স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর শান্তিরঞ্জন কুণ্ডুও। দু’পক্ষকে বুঝিয়ে কাউন্সিলর এলাকা ছাড়েন। বসে পুলিশ পিকেট।
পুলিশ সূত্রের খবর, মঙ্গলবার সকালে ফের শুরু হয় মারপিট। ক্রমে লাঠি, ইট, পাথর এবং বোতল নিয়ে লড়াইয়ের আকার নেয়। পুলিশের সামনেই একে অপরকে আক্রমণ করে দু’পক্ষ। সেই আক্রমণের মাঝে পড়ে আহত হন পুলিশকর্মীরাও। একদল যুবক পাশের রেললাইনে উঠে পাথর ছুড়তে থাকায় সকালে ওই লাইনে ট্রেন চলাচলও বিঘ্নিত হয়। রেলের তরফে জানানো হয়েছে, গণ্ডগোলের সময়ে দু’তরফের ছোড়া পাথর এসে পড়ে ট্রেনেও। ট্রেনযাত্রীদের বাঁচাতে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বিধাননগর রোড স্টেশন পর্যন্ত রেললাইনের ধার ঘেঁষে আরপিএফ জওয়ানদের পাহারায় বসাতে বাধ্য হন রেল কর্তৃপক্ষ। গণ্ডগোলের সময়ে একদল বাসিন্দা স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী সাধন পাণ্ডের বাড়ির সামনে ধর্নায় বসেন। পুলিশ লাঠি চালিয়ে ধর্না তুলে দিলে সাধনবাবুই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পুলিশকে নিরস্ত করেন। এর পরেই ওঠে ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে’র অভিযোগ।
তবে এই ঘটনায় রাজনীতির কোনও যোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করেনি পুলিশ। কলকাতা পুলিশের ডিসি (ইএসডি) দেবস্মিতা দাস বলেন, ‘‘শনিবার একটি খেলাকে কেন্দ্র করেই গণ্ডগোলের সূত্রপাত। এতে কোনও রাজনীতি নেই।’’ যদিও কৃষ্ণপল্লির একাধিক বাসিন্দার অভিযোগ, তাঁরাও সকলে তৃণমূলের সমর্থক। তবু স্থানীয় কাউন্সিলরের লোকেরা তাঁদের পাড়ার ছেলেকে মেরেছে। প্রতিবাদ জানাতেই মন্ত্রীর বাড়ির সামনে ধর্না দিতে গিয়েছিলেন তাঁরা। যদিও ওই সব অভিযোগ উড়িয়ে সাধনবাবু বলেন, ‘‘দুটো পাড়ার ঝগড়া। অভিভাবক হিসেবে এক পাড়ার লোকেরা তো আমার কাছে আসতেই পারে। তাই এসেছিল। রাতেই দু’পক্ষকে ডেকে মিটিয়ে দিচ্ছি। এর সঙ্গে তৃণমূলের কোনও যোগ নেই।’’ তবে সাধনবাবুর খাস তালুকে এই ঝগড়া লাগানোর পিছনে সিপিএমের ফন্দি রয়েছে বলে জানান ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর তথা স্থানীয় বরো চেয়ারম্যান অনিন্দ্যকিশোর রাউত। তিনি বলেন, ‘‘একটা সময়ে এই এলাকায় রাজ করত সিপিএম। এখন ওদের পতাকা তোলার লোক কমে গিয়েছে। তাই তৃণমূলে ভাঙন ধরানোর চেষ্টায় নেমেছে।’’ সিপিএমের স্থানীয় নেত্রী রূপা বাগচী পাল্টা বলেন, ‘‘ঝামেলা ওঁদের নিজেদের মধ্যেই হয়েছে। আমাদের ইন্ধন দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। ’’
নিজের বাড়ির কাছে বিক্ষোভ সামলাচ্ছেন স্থানীয় বিধায়ক ও মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। মঙ্গলবার।
তবে, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং রাজনীতি থাক বা না থাক, পুলিশের সামনে সাধারণ মানুষ কী করে এ ভাবে আইন নিজেদের হাতে তুলে নেন, মূল প্রশ্ন উঠেছে সেখানেই। পুলিশের একাংশ জানাচ্ছে, সোমবার রাতে গণ্ডগোলের পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে তা মিটে যায়। ঘটনাস্থলে পুলিশ পিকেট বসে। মঙ্গলবার সকালে সেই পুলিশকর্মীদের সামনেই ফের গোলমাল বাধে। পুলিশ তা সামলাতে গেলে সাব-ইনস্পেক্টর যুগলকিশোর ঝাঁ-র মাথা ফেটে যায়। পায়ে আঘাত লাগে মানিকতলা থানার ওসি দেবাশিস দে-রও।
পুলিশ জানিয়েছে, ততক্ষণে দু’পক্ষের প্রায় ছ’শো লোক জড়ো হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি সামলানো যায়নি। সাময়িক ভাবে পুলিশকে পিছিয়ে আসতে হয়! এর পরে র্যাফ ও পুলিশ বাহিনী এসে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনে। প্রশ্ন উঠছে, পুলিশের উপস্থিতির সামনেই এ ভাবে গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়ার মতো সাহস সাধারণ মানুষ পাচ্ছেন কী করে? পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত ওই ঘটনায় মোট ২৮ জন স্থানীয় বাসিন্দাকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে চার মহিলা-সহ ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এমন গোলমালের ঘটনায় বিরোধীরা আঙুল তুলেছে শাসক দলের দিকেই। বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের কথায়, ‘‘কলকাতা শহরে তুমুল সংঘর্ষে স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কিত। ট্রেনযাত্রীরা জানলা বন্ধ করে মাথা বাঁচাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল নেতৃত্বের দলের উপরে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। যেখান থেকে যে পারছেন, দল ভাঙিয়ে আনছেন। তার পরে সেই দলের উপরে কোনও কর্তৃত্ব থাকছে না!’’ বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী এত কথা বলার পরে পুলিশের কী হল? তারা কি ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল নাকি গোলমাল থামানোর জন্য এগোতে সাহস পাচ্ছিল না? আসলে সমাজবিরোধীরা দলে ঢুকে প়ড়লে এ রকমই হয় !’’
যদিও এলাকা সূত্রের খবর, নতুনপল্লিতে ২৫০ জন ঝুপড়িবাসীর মধ্যে ২২০ জন ফ্ল্যাট পেয়েছেন, ৩০ জন এখনও বাকি। অন্য দিকে, কৃষ্ণপল্লিতে ৫৬০ জনের মধ্যে ফ্ল্যাট পেয়েছেন মাত্র ১০০ জন। ৪৬০ জন এখনও পাননি। বিবাদ তা নিয়েই।
ছবি: শৌভিক দে
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy