Advertisement
০৩ অক্টোবর ২০২৪

হোর্ডিং খুলতে জীবনের ঝুঁকি, উদাসীন সকলেই

বৃষ্টি থামতেই হোর্ডিং খুলতে তৎপর হন স্থানীয় পুজোর কয়েক জন উদ্যোক্তা। মাথায় গামছা বেঁধে যাঁরা তিনতলা সমান বাঁশের কাঠামোয় ওঠার তোড়জোড় শুরু করলেন, তাঁদের কারও কোনও রকম নিরাপত্তার বন্দোবস্ত নেই!

অসুরক্ষিত: নেই নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে হোর্ডিং নামাচ্ছেন দুই কর্মী। ছবি: রণজিৎ নন্দী

অসুরক্ষিত: নেই নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে হোর্ডিং নামাচ্ছেন দুই কর্মী। ছবি: রণজিৎ নন্দী

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৯ ০৩:০৭
Share: Save:

ফুটপাত জুড়ে পুজো উপলক্ষে লাগানো হয়েছিল হোর্ডিং, নানা রঙের আলো। একাদশীর দুপুরে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে নিমতলা স্ট্রিটে একটি তেতলা বাড়ির ছাদের জল অঝোরে পড়ছিল এমনই আলোর তারের উপর। জলের তোড়ের মধ্যে দিনেও কোনও মতে জ্বলছিল সেগুলি।

বৃষ্টি থামতেই হোর্ডিং খুলতে তৎপর হন স্থানীয় পুজোর কয়েক জন উদ্যোক্তা। মাথায় গামছা বেঁধে যাঁরা তিনতলা সমান বাঁশের কাঠামোয় ওঠার তোড়জোড় শুরু করলেন, তাঁদের কারও কোনও রকম নিরাপত্তার বন্দোবস্ত নেই! মাথায় হেলমেট, কোমরে দড়ির ব্যবস্থা করা তো দূর, বৃষ্টির জল পড়ে বৈদ্যুতিক তারগুলিরই বা কী অবস্থা, সেই চিন্তাও কেউ করলেন না! জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ ভাবে হোর্ডিং খোলার কাজ করাচ্ছেন কেন? প্রশ্ন শুনে ওই পুজোরই উদ্যোক্তা শঙ্কর হালদার বললেন, ‘‘এ নিয়ে তো আগে কেউ কখনও বলেননি। পরের বার থেকে মাথায় রাখব।’’

শুধু নিমতলা স্ট্রিটই নয়, পুজো শেষে শহর জুড়ে কোনও রকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই ব্যানার-হোর্ডিং খোলার কাজ চলছে বলে

অভিযোগ। কোথাও তিন-চারতলা সমান উচ্চতায় হোর্ডিং খুলতে কর্মীরা উঠে পড়ছেন স্রেফ বাঁশ বেয়ে। কোথাও আবার শহরের সেতুর রেলিংয়ের গায়ে লাগানো হোর্ডিং এক জন খুলছেন আর এক জনের কাঁধে দাঁড়িয়ে। গড়িয়াহাট মোড়ের একটি হোর্ডিং খোলার সময়ে আবার দেখা গেল, যে বাড়ির সামনে হোর্ডিংটি লাগানো ছিল সেটির বারান্দা থেকে বাঁশের কাঠামোর উপরে লাফিয়ে পড়লেন এক জন। পরে সেই ব্যক্তিকে নামিয়ে আনা হল কাঁধে করে। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে আবার বিদ্যুতের তারের জটের পাশে দাঁড়িয়ে এক কর্মীকে হোর্ডি‌ং নামানোর কাজ করতে দেখা গিয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী, শহরের যে কোনও উঁচু জায়গায় কাজ করতে গেলে নির্দিষ্ট নিরাপত্তা-বিধি মেনে চলতে হয়। এ নিয়ে পুরসভারও স্পষ্ট নির্দেশিকা রয়েছে। নির্মাণ সংস্থাগুলির সংগঠন ‘ক্রেডাই’-এর প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য সুশীল মেহতা জানান, নির্মাণস্থলে তো বটেই, হোর্ডিং খোলার জন্যও কর্মীদের মাথায় হেলমেট থাকা বাধ্যতামূলক। কোনও ভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নীচে পড়া আটকাতে কোমরে বেঁধে রাখতে হয় দড়ি। এ ছাড়া যেখানে হোর্ডিং খোলার কাজ হচ্ছে, সেখানে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা (ফার্স্ট এড) রাখা এবং কর্মীদের গায়ে চকচকে জ্যাকেট থাকা অবশ্যই প্রয়োজন। তাঁর কথায়, ‘‘দূর থেকে সহজেই যাতে চোখে পড়ে, তাই ওই জ্যাকেট। এই সব নিয়ম মানার কথা থাকলেও কোথাও মানা হয় বলে মনে হয় না। পুজো উদ্যোক্তারাও উদাসীন।’’

নিরাপত্তা নিয়ে এই উদাসীনতা কেন?

কাশী বোস লেনের পুজো উদ্যোক্তা সোমেন দত্ত জানান, বিজ্ঞাপন দিয়েছে যে সংস্থা, তারাই পুজোর পরে বেশির ভাগ হোর্ডিং খুলে দেয়। বাকি হোর্ডিং পুজো উদ্যোক্তারা নিজেরা খোলানোর ব্যবস্থা করেন। অনেক দিন পর্যন্ত পড়ে থাকলে পুরসভাই তার পরে হোর্ডিং খুলে দেয়। তাঁর কথায়, ‘‘আগে এই নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায়

আসেনি। কেউ পরামর্শও দেননি। পরের বার থেকে ব্যাপারটা মনে রাখব।’’ একই দাবি দেশপ্রিয় পার্কের পুজো উদ্যোক্তা সুদীপ্ত কুমারের। তিনি বললেন, ‘‘দর্শনার্থী আর পুজো উদ্যোক্তাদের নিরাপত্তার জন্য কিছু ব্যবস্থা রাখি আমরা। তবে হোর্ডিং খোলার কাজ করেন যাঁরা, তাঁদের কথা সত্যিই ভাবা হয়নি।’’

গত জুলাইয়েই রাজ্য সরকারের মৎস্য সমবায় সংস্থা ‘বেনফিশ’-এর আবাসনে ৭০ ফুট উঁচু জলাধার থেকে পড়ে মৃত্যু হয়েছে এক সাফাইকর্মীর। ২৭ দিন হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন নারায়ণ ঘোষ নামে আর এক সাফাইকর্মী। অত উঁচু থেকে পড়ায় তাঁর পেটের ভিতরের সব অংশ বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। এখনও তিনি কাজে যোগ দিতে পারেননি। এ দিন বাড়ির বিছানায় শুয়ে তিনি বলেন, ‘‘কর্মী ভাইদের বলব, যাঁর হয়েই কাজ করুন, কেউ বললেও নিরাপত্তা ছাড়া অত উঁচুতে উঠবেন না। আমি নিজের জীবন দিয়ে বুঝছি!’’

শহর বুঝবে কি? প্রশ্ন থেকেই যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE