Advertisement
E-Paper

রেলমন্ত্রীকে এক মেট্রোযাত্রীর খোলা চিঠি

মাননীয় সুরেশ প্রভু, একটা সময়ে ভাবতাম মেট্রো রেলের মতো নির্বিঘ্ন যাত্রা বোধহয় আর কিছুতে নেই। নিত্যদিন অফিস আসার জন্য মেট্রোই যে সব চেয়ে নিরাপদ এবং দ্রুত মাধ্যম, সেটা সবাইকে বড়াই করে বলতামও।

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:০৬

মাননীয় সুরেশ প্রভু,

একটা সময়ে ভাবতাম মেট্রো রেলের মতো নির্বিঘ্ন যাত্রা বোধহয় আর কিছুতে নেই। নিত্যদিন অফিস আসার জন্য মেট্রোই যে সব চেয়ে নিরাপদ এবং দ্রুত মাধ্যম, সেটা সবাইকে বড়াই করে বলতামও। ক্ষুদিরাম থেকে মাত্র আধ ঘণ্টায় পৌঁছে যেতাম চাঁদনি চকে। ওই আধ ঘণ্টায় একটা ভাতঘুমও হয়ে যেত!

কিন্তু সেই ‘নিরাপদ’ যাত্রা ক্রমেই দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। আধ ঘণ্টার রাস্তা যেতে যেমন ৪০ মিনিট লাগছে, তেমনই আচমকা অফিসটাইমে একটা ট্রেন বাতিল করে যাত্রীদের আরও বিপদে ফেলে দিচ্ছে মেট্রো। প্রতিটি স্টেশনে জরুরি ঘোষণার জন্য মাইক্রোফোন রয়েছে, রয়েছে স্পিকারও। কিন্তু কোনও কারণে ট্রেন বাতিল করলে এক বারের জন্যও সেই স্পিকারে কোনও ঘোষণা শোনা যায় না। ব্যতিক্রম শুধু মেট্রোয় ঝাঁপ দেওয়ার ঘটনা।

মেট্রোর এই আগাম কিছু না জানিয়ে আচমকা ট্রেন বাতিল করার ফল কী হয়, বৃহস্পতিবার আমাদেরই কয়েক জন সহকর্মী তা প্রত্যক্ষ করেছেন। ভিড়ের ঠেলায় পড়ে গিয়ে এক মহিলা সহকর্মীকে পায়ে ক্ষত নিয়ে অফিসে আসতে দেখেছি। মেট্রোর তরফে কেউ আমাদের ওই সহকর্মীকে সাহায্য পর্যন্ত করেননি। কোলে বাচ্চা নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছেন মহিলা যাত্রীরা। মেট্রোকর্মীদের ধারেকাছে দেখা যায়নি। এমনকী, একই সঙ্গে স্টেশনে দু’দিক থেকে আসা দু’টি ভিড়ে ঠাসা ট্রেন যাত্রী উগরে দিলেও মেট্রো রেলের কর্মীরা অতিরিক্ত স্মার্ট গেট খোলেননি। আগে দেখা যেত, এ রকম পরিস্থিতিতে টোকেন থাকা যাত্রীদের অন্য পথ দিয়ে বার করে দেওয়া হতো। এখন দু’তিন জন কর্মী স্মার্ট গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও তাঁরা নির্বিকারই থাকেন।

মেট্রোকর্মীদের অমানবিক আচরণ এটাই অবশ্য প্রথম নয়। এর আগেও এক বার প্রায় দেড় ঘণ্টা সুড়ঙ্গে আটকে থেকে দেখেছি মেট্রোর ছোট, বড়, মেজ কোনও কর্তাই আটকে থাকা যাত্রীদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেননি। এমনকী উদ্ধার পাওয়ার পরে কোনও চিকিৎসককে প্ল্যাটফর্মে দেখিনি। সুড়ঙ্গে আটকে থাকা গলদঘর্ম যাত্রীদের এক গ্লাস জলও এগিয়ে দেননি কেউ!

তবে শুক্রবার সকালে যা ঘটল, তা বোধহয় অতীতের সব দুর্ভোগকে ছাড়িয়ে যাবে।

সকালে ৯টা ৩৩-এর মেট্রো চলে গেল চোখের সামনে দিয়ে। ডাউন লাইনে ঠিক তখনই কবি সুভাষের দিকে চলে গেল আর একটা ট্রেন। অর্থাৎ, ট্রেন ঠিকঠাক চলছে। প্ল্যাটফর্মের ট্রেন নির্দেশিকাও বলে দিচ্ছে, পরের ট্রেন ৯টা ৩৯ মিনিটে।

৯টা ৩৯ পেরিয়ে গেল। পেরিয়ে গেল ৯টা ৪৫-ও। এর মধ্যেই আরও দুটো ডাউন ট্রেন চলে গেল। কিন্তু আপ ট্রেনের দেখা নেই। কোনও ঘোষণাও নেই। স্টেশনে ভিড় বাড়ছে।

ক্ষুদিরাম স্টেশন থেকেই মেট্রোর এক কর্তাকে ফোন করলাম, ‘ট্রেন বাতিল করতেই পারেন। কিন্তু কী হয়েছে, সেই ঘোষণাটা করছেন না কেন?’ ওপাশ থেকে জবাব এল, ‘দেখছি দেখছি।’

৯টা ৪৮ মিনিটে একটা এসি ট্রেন এল। তখনও কোনও ঘোষণা নেই। হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম ট্রেনে। মেট্রের রেলের কর্তাটি ফোন করলেন— ‘কবি সুভাষে ট্রেন ঘোরার সময়ে আটকে গিয়েছিল। তাতেই বিপত্তি।’

সেটা যাত্রীদের জানাতে কোনও অসুবিধা ছিল কি? ওই অফিসারের ফোন কেটে গেল।

পরের স্টেশন কবি নজরুল। যাত্রী তুলে দরজা বন্ধ অবস্থাতেই ট্রেন দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। এক সহযাত্রী বলে উঠলেন, একসঙ্গে তিনটি ট্রেন বসিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত হচ্ছে। গীতাঞ্জলিতে ঠিকঠাক। মাস্টারদা সূর্য সেনে গিয়ে ফের দরজা বন্ধ অবস্থায় মিনিট দুয়েকের দম নেওয়া। নেতাজিতেও তাই। এক বার গার্ডের গলা শোনা গেল, ‘‘দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালে ট্রেন কিন্তু ছাড়বে না।’’ অর্থাৎ তখনই ট্রেন ভর্তি হয়ে গিয়েছে। মহানায়ক উত্তমকুমার স্টেশনে (টালিগঞ্জ) কী অবস্থা, সেই ভেবেই তখন আতঙ্কিত কামরার যাত্রীরা।

টালিগঞ্জে যখন ট্রেন ঢুকছে, প্ল্যাটফর্মে প্রায় তিন ট্রেনের লোক অপেক্ষায়। এক সহযাত্রী বললেন, ‘দেখলেন? ঠিক তিনটে ট্রেন বাঁচিয়ে দিল।’ টালিগঞ্জ স্টেশনের ভিড় দেখে মোটরম্যান দরজা খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। ঠিক তখনই বোধহয় একটা ঘোষণা হল। দেখলাম অপেক্ষমান যাত্রীরা পাশের প্ল্যাটফর্মের দিকে ছুটছেন। উত্তমকুমার থেকে বোধ হয় বিশেষ আপ ট্রেন ছাড়ার ঘোষণা হল। ততক্ষণে মোটরম্যান দরজা খুলে যাত্রী নামিয়ে দিয়েছেন। ফের শুরু হয়ে গেল ওঠার জন্য হুড়োহুড়ি। কোনও মতে দরজা বন্ধ। কিন্তু ট্রেন আর ছাড়ে না। ফের চার মিনিট।

রবীন্দ্র সরোবর, কালীঘাটে কী হবে, তখনই বুঝতে পারছিলাম। চোখ বন্ধ করে শক্ত হাতে রড ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। দরজার কাছে চেঁচামেচি, আর্তনাদ শুনে বুঝতেই পারছিলাম কী ঘটছে। কিন্তু যে আড়ালে ছিলাম, সেখান থেকে মুখ বার করে দেখার সাহস জোটাতে পারিনি।

রবীন্দ্র সরোবরে ভিতর থেকে কয়েক জন যাত্রীকে বলতে শোনা গেল, ‘টালিগঞ্জ থেকে স্পেশাল ট্রেন দিচ্ছে। ওটায় উঠুন।’ বাইরে থেকে আওয়াজ এল, ‘মেট্রো রেল কত পয়সা দিয়েছে মশাই! আপনার অফিস আছে, আমাদের নেই?’ ভিতর থেকে আর জবাব গেল না।

এসি মেট্রোয় বসে তখন গলগল করে ঘামছি। হাওয়া আর ঠান্ডা নেই। ভাবছি কতক্ষণে পৌঁছব চাঁদনিতে। এসপ্ল্যানেডে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। কিন্তু ওই স্টেশন থেকে ওঠা ভিড়টা ফের নিয়ে চলে গেল ভিতরে। আবার ঠেলেঠুলে দরজার কাছে এসে পজিশন নিলাম। পিছনে অন্তত ১০ জন।

এক সময়ে চাঁদনি চক এল। ভিতর থেকে ভিড়টাই ঠেলা দিয়ে নামিয়ে দিল স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মের ঘড়িতে তখন ১০টা ৩২। মেট্রো রেলের কর্তাটিকে ফের ধরার জন্য ফোন করলাম। বেজে বেজে কেটে গেল।

মাননীয় রেলমন্ত্রী মহাশয়,

রেলের ওই কর্তাটি ফোন ধরলে তাঁকে কয়েকটি প্রশ্ন করার ইচ্ছে ছিল। আশা করি, আপনি সেই প্রশ্নগুলির যথাযথ জবাব দেবেন।

যাত্রীদের এই দুর্ভোগের জন্য মেট্রো কেন কখনও তাঁদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করে না?

কেনই বা ট্রেন বাতিল হওয়া কিংবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেলে কখনও ঘোষণা করে না মেট্রো?

ট্রেন যখন অনিয়মিত তখন বিভিন্ন স্টেশনে টিকিট দেওয়া কেন সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখে না মেট্রো?

কেনই বা একসঙ্গে অতিরিক্ত যাত্রী নামলে সব স্মার্ট গেট খোলা হয় না?

কোনও বিপন্ন যাত্রীকে সাহায্য না করে কেনই বা মেট্রো কর্মীরা নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে থাকেন?

ট্রেন যখন অনিয়মিত, যাত্রীরা যখন দুর্ভোগের শিকার, তখন কেন মেট্রো-কর্তাদের দেখা যায় না স্টেশনগুলিতে? কলকাতার মেট্রো কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে নীরব। তাই আপনাকেই লিখলাম।

নমস্কার।

দেবদূত ঘোষঠাকুর

Metro passenger Letter
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy