মা-বাবার সঙ্গে অর্জন। — নিজস্ব চিত্র
পাঁচ বছর নির্বাক জীবন কাটিয়ে প্রথমবার ‘মা’ বলল অর্জন। বাংলাদেশের সিলেটের বাসিন্দা এই শিশুকে শব্দের জগতে প্রবেশ করালেন কলকাতার চিকিৎসকেরা।
সিলেট জেলার শ্রীমঙ্গলের বাসিন্দা অমিয়াংশু এবং অসীমা ভট্টাচার্যের সন্তান অর্জন জন্ম থেকেই ছিল মূক ও বধির। মা ডাক শোনার অপেক্ষায় দিন গুনতেন অসীমা। ছোট্ট অর্জনকে কথা শেখানোর জন্য অমিয়াংশুও দিনভর অনেক কথাই বলে যেতেন। কিন্তু অর্জন শুধু তাকিয়ে থাকত, কিছুই বলত না। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে একের পর এক চিকিৎসককে দেখানোর পরে কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে আনা হয় তাকে। ১১ এপ্রিল সেখানে এক জটিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা গিয়েছে অর্জনের শ্রবণ ক্ষমতা। বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে শুরু হয়েছে স্পিচ-থেরাপি। আধো আধো স্বরে শুরু সে শুরু করেছে কথা বলা।
সাড়ে তিন বছর আগে প্রথম বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, অর্জনের কানে কোনও বড় সমস্যা আছে। আশপাশের কথা তার মস্তিষ্কে ঢুকছেই না। চিকিৎসকের পরামর্শে ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় যান অমিয়াংশু। ঢাকার চিকিৎসক অর্জনকে পরীক্ষা করার পরে বলেন, তার কানের গভীরে ককলিয়ায় সমস্যা আছে। কোনও শব্দই তার মস্তিষ্কে না পৌঁছনোর ফলে শব্দ শিখছে না অর্জন। চিকিৎসকদের কথায়, ‘‘শব্দ শুনলে তবেই না বলতে শিখবে!’’
অমিয়াংশুবাবু পরিচিতদের থেকে জানতে পারেন, কলকাতা থেকে এক জন ইএনটি বিশেষজ্ঞ নিয়মিত বাংলাদেশে যান। সেই চিকিৎসক চন্দন সাহা তাঁকে জানান, জন্মগত ভাবে যাঁরা বধির তাঁদের চিকিৎসাও রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করলে সমস্যা কিছুটা কমে। চন্দনবাবুর পরামর্শ মতো কলকাতার ওই বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন অমিয়াংশুবাবু। সেখানে চিকিৎসকেরা জানান, অর্জন যখন মায়ের গর্ভে ছিল তখনই কোনও ভাইরাসের আক্রমণে সে শোনার ক্ষমতা হারায়।
ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট কী?
চিকিৎসকেরা জানান, যাঁদের ককলিয়ায় সমস্যা আছে আশপাশের শব্দ তাঁদের অন্তঃকর্ণে পৌঁছয় না। ফলে, সাধারণ মানুষদের ক্ষেত্রে স্নায়ু বেয়ে শব্দ যেমন মস্তিষ্কে পৌঁছয়, অর্জনদের ক্ষেত্রে তা হয় না। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ককলিয়ায় একটি ইলেকট্রিক্যাল কয়েল বসানো হয়। সেটির সাহায্যে ককলিয়ার সমস্যার জন্য যাঁরা বধির, তাঁরা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট একটি জটিল, ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ অস্ত্রোপচার বলে জানান চিকিৎসকেরা।
মুকুন্দপুরের আমরি হাসপাতালের ইএনটি চিকিৎসক অমিতাভ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘অস্ত্রোপচার সহজ ছিল না। সাধারণত, একটি কানেই ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করা হয়। দু’টি কানে হয় না। একটি কান দিয়েই শুনতে হয়। কিন্তু, অর্জনের ক্ষেত্রে একসঙ্গে দু’টি কানের ইমপ্ল্যান্ট করা হয়েছে।’’ অমিতাভবাবু জানান, অর্জনের একটি কানে ইমপ্ল্যান্ট করা হলে কিছুটা সমস্যা মিটত ঠিকই, কিন্তু আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো শুনতে পেত না সে। কারণ, একটি কানের মাধ্যমে সব শব্দ মস্তিষ্কে পৌঁছয় না। কিন্তু দু’কানের অস্ত্রোপচার করা হলে সম্পূর্ণ বধিরতা দূর হয়।
ইএনটি বিশেষজ্ঞ সম্রাট বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘এর আগে কলকাতায় একসঙ্গে দু’টি কানের ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট হয়নি। এ বার থেকে যাঁরা সম্পূর্ণ বধির, দু’কানে ইমপ্ল্যান্টের পরে তাঁরা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন।’’
এই অস্ত্রোপচারকে স্বাগত জানিয়ে ইএনটি বিশেষজ্ঞ দীপঙ্কর সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘একসঙ্গে দু’টি কানে ইমপ্ল্যান্ট বিরল।’’ যদিও এর কিছু সংশয়ের দিকও উল্লেখ করেছেন ইএনটি বিশেষজ্ঞ অরুণাভ সেনগুপ্ত। এখনই এই অস্ত্রোপচারকে সফল বলতে নারাজ তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘সচরাচর দু’কানে ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট হয় না। সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। এ ক্ষেত্রে সেই ঝুঁকি এখনই কেটেছে কি না, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। আরও কিছুদিন রোগীর পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy