আমার তো পাড়া বলতে প্রথমেই মাথায় আসে ম্যাডক্স স্কোয়ার চত্বর। খোলা মাঠ, প্রাতর্ভ্রমণ, আমাদের বিখ্যাত সাবেক পুজো, আড্ডা— সবের মধ্যেই তো জড়িয়ে আছে পাড়াটা। আর আমার মতো ম্যাডক্সের এই পুজোও তো এ বার পার করবে ৮০ বছর।
১৯৩৫ সালে হাজরা রোডের বাড়িতেই জন্ম আমার। কিন্তু বাবা লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, তাই আমাদের তিন ভাইয়ের স্কুলশিক্ষাও সেখানেই। কলকাতায় চলে আসি ১৯৫১ সালে, বাবার মৃত্যুর পরে। বাকি পড়াশুনা এখানেই। পুলিশের চাকরি, তাই ফের কলকাতা-ছাড়া হতে হল। বদলির চাকরিতে শিলিগুড়ি, কালিম্পং, চব্বিশ পরগনা, মালদহ, দার্জিলিং ইত্যাদি ঘুরে ১৯৭২ সালে স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের ডিসি হয়ে ফের আসি কলকাতায়। তখন থেকে এখানেই রয়েছি। হাজরা রোডের বাড়িতেই।
আমাদের এলাকাটা কিন্তু বিশাল। ল্যান্সডাউন, রিচি রোড, হাজরা রোড, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড— সবই এর মধ্যে পড়ে। এই বিশাল এলাকায় সবচেয়ে নজরকাড়া আমাদের ম্যাডক্স স্কোয়ার। সবুজ মাঠ, গাছপালা, সব মিলিয়ে দারুণ এক পরিবেশ। যদিও গাছের সংখ্যা এখন আগের থেকে খানিকটা কমেছে। অবশ্য এখন অনেকেই এখানে নিজেদের উদ্যোগে গাছ লাগাচ্ছেন। আমিও একটা সময়ে গাছ লাগিয়েছিলাম। এর একটা কারণ, অনেক বেশি গাছ থাকলে বেশি পাখিও আসবে। ঝকঝকে ফ্ল্যাটবাড়িগুলিতে ঘুলঘুলি না থাকায় এখন চড়ুই পাখির সংখ্যাও যেমন অনেক কমে গিয়েছে।
যদিও এখন গোটা শহর জুড়ে সর্বত্র ফ্ল্যাটবাড়ির আধিক্য, তবু বলতে পারি আমাদের পাড়ায় কিন্তু সেই সংখ্যাটা অনেক কম। আশপাশের কিছু বাড়ি ফ্ল্যাট হয়েছে, কাছেই বিশাল পেয়ারাবাগান বস্তি এলাকাতেও কিছু ফ্ল্যাট উঠেছে। কিন্তু পাড়ার পুরনো চেহারাটা এখনও বহাল রয়েছে। এখনও আগের মতোই পাড়ার সকলের মধ্যে সদ্ভাব বজায় রয়েছে। সকলেই মোটামুটি একে অপরকে চেনেন। আর পুরনো বাসিন্দা হলে তো কথাই নেই। সেখানে তো পাড়াটাই বাড়ির মতো। ফ্ল্যাট হয়ে যাওয়ায় অবশ্য অনেক নতুন লোকজন এখন এ পাড়ায় থাকেন। মূলত বাঙালি পাড়া হলেও এখন বহু অবাঙালি, বিশেষত গুজরাতিদের বাস এখানে। তাঁদের অবশ্য অনেকেই অচেনা। আবার নাম না জানলেও অনেকে মুখচেনা।
বিভিন্ন ধরনের লোকের বাস এই পাড়া বেশ শান্তিপূর্ণ। পেয়ারাবাগান বস্তি এলাকায় মাঝেমধ্যে একটু গোলমাল হয় বটে, তবে তা খুব সাংঘাতিক নয়। ম্যাডক্স-এর উল্টো দিক থেকে শুরু করে এই বস্তি ছড়ানো প্রায় বালিগঞ্জ থানা এলাকা পর্যন্ত। এই কিছু দিন আগেই যেমন দু’দিকের শীতলা পুজো নিয়ে গোলমালে বেশ খানিকক্ষণ আটকে ছিল ল্যান্সডাউন রোড। এ ছাড়া এখানে পাড়ার বা রাজনৈতিক কোনও গোলমাল কিন্তু একেবারেই নেই। রাতে পুলিশ পাহারাও থাকে। তবে মাঝেসাঝে কিছু যে ঘটে না তেমন নয়। কিন্তু সংখ্যা খুবই কম। এই যেমন বছর দুই আগে এই এলাকাতেই ভরদুপুরে এক মহিলাকে দাঁড় করিয়ে তাঁর গয়না ছিনতাই করা হয়। তার পরেও এক মহিলার গলার হার ছিনতাইয়ের কথা শুনেছিলাম। আগে যেমন এখানকার রাস্তাঘাটে অনেক রাতেও নিরাপদে যাতায়াত করা যেত, এখন বাসিন্দারা একটু ভয়ই পান। আগে বাড়ির মহিলারা নাইট শো-এ হেঁটেই বসুশ্রীতে সিনেমা দেখতে যেতেন বা দেখে ফিরতেন। কখনও কোনও অসুবিধায় পড়তে হয়নি। আর এখন রাতের দিকে পাশে আর্ল স্ট্রিট দিয়েও যেতে একটু ভয় পান সকলে। অবশ্য এখন সব এলাকাতেই একই অবস্থা।
এখানে রাস্তাঘাট অবশ্য আগের মতো একই রকম রয়েছে। খোঁড়াখুঁড়ি করে কোথাও কাজ হলেও খুব দ্রুত রাস্তা মেরামত হয়ে যায়।
যদিও ফুটপাথগুলি যে কেন উঁচু করে তৈরি করা হয়েছে, জানি না। বয়স্কদের সেখানে ওঠা-নামায় একটু অসুবিধাই হয়। এ ছাড়া আর বিশেষ সমস্যা নেই। আগের মতো এই এলাকায় এখন আর বেশি জলও জমে না। ল্যান্সডাউন, রিচি রোড, সেন্ট লরেন্স স্কুলের কাছে খানিক জল জমলেও তা খুব তাড়াতাড়ি নেমে যায়। ভ্যাটও পরিষ্কার করা হয় নিয়মিত।
পুজোয় আমাদের পাড়ার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ম্যাডক্স স্কোয়ার। আমারই ঠাকুরদা মোহিনীকান্ত ঘটক এবং পাশের বাগচী পরিবার— এঁরাই প্রথম এই পুজো শুরু করেন। ঠাকুরদা ছিলেন এই পুজোর প্রথম প্রেসিডেন্ট। আগে এটা ছিল শুধুই পাড়ার পুজো। কেউ অঞ্জলি দিতে, কেউ বা শুধুই আড্ডায়— এখন তো গোটা কলকাতা থেকে লোকজন এখানে আসেন। আসেন সেলিব্রিটিরাও। বরাবরের মতো পাড়ার মহিলারাই এখনও একজোটে পুজোর সমস্ত কাজ করেন। তবে আগের চেয়ে এখানকার পরিবেশ কিন্তু খানিকটা বদলেছে। এ পাড়ায় সব অনুষ্ঠানে পরের প্রজন্ম থাকলেও তার সংখ্যা একটু কম। আমাদের বাড়িতে অবশ্য এখনও সব প্রজন্মই পুজোর কাজে সমান ভাবে আগ্রহী। তবে এখন পুজো অনেক বেশি স্পনসর পায় বলে তাদেরও খানিকটা অধিকার চলেই আসে। এই যেমন দশমীতে মণ্ডপে সেলিব্রিটিদের নিয়ে সিঁদুর খেলা চলে। পাড়ার মহিলারা সুযোগ পান তার পরে। এ তাঁদের খানিক ক্ষোভেরই জায়গা। পুজোয় ম্যাডক্সে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত নতুন প্রজন্মের যে ভিড় থাকে, তাতেও কিছু দলের আচরণের কারণে সন্ধ্যা থেকে মাঠের কোথাও কোথাও পরিবেশটা একটু বদলে যায়। তবে যা-ই হোক, পুজোয় কিন্তু গোটা পাড়া এক পরিবার।
ম্যাডক্স স্কোয়ারে অবশ্য সারা বছরই থাকে আড্ডার পরিবেশ। প্রাতর্ভ্রমণের পরেও চলে আড্ডা। কখনও তা চলে মাঠের পাশের চায়ের দোকানির সঙ্গেও।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই বদলেছে অনেক কিছু। তবে বলতে পারি পাড়ার পরিবেশের তেমন কোনও অবনতি হয়নি। ছন্দে, আনন্দে ভালই আছি আমরা।
লেখক প্রাক্তন পুলিশ-কর্তা