কিনারা: ব্যাঙ্কশাল আদালতে মহম্মদ আরশাদ। (ডান দিকে) উদ্ধার হওয়া রত্ন ও টাকা। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র।
চার মাস আগে থেকেই জাকারিয়া স্ট্রিটের রত্ন ব্যবসায়ী মহম্মদ সেলিমের দোকানে লুঠের ছক কষেছিল অভিযুক্তেরা। সেলিমের দোকানে লুঠ ও তাঁকে খুনে মূল অভিযুক্ত আর এক রত্ন ব্যবসায়ী মহম্মদ আরশাদ ফিরদৌসিকে জেরা করে এমনই দাবি করছেন গোয়েন্দারা। পুলিশ জানিয়েছে, এই ঘটনায় আরও কয়েক জন জড়িত। তাঁদের শনাক্ত করতে পারলেও এখনও পর্যন্ত পাকড়াও করতে পারেননি তদন্তকারীরা। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, তাদের পাকড়াও করতে ইতিমধ্যেই ভিন্ রাজ্যে পৌঁছেছে লালবাজারের গোয়েন্দা-দল।
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান বিশাল গর্গ শুক্রবার জানান, জেরায় আরশাদ আগেই দোষ কবুল করেছিলেন। লুঠের মালপত্র কোথায় রয়েছে, এ দিন তা-ও জানিয়েছেন তিনি। আরশাদের সঙ্গে গিয়ে একবালপুরের একটি জায়গা থেকে ৬টি দামি রত্ন এবং ৯২ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এ দিন ব্যাঙ্কশাল আদালতে হাজির করানো হলে বিচারক ধৃত ব্যবসায়ীকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
সোমবার রাত সা়ড়ে ন’টা নাগাদ জাকারিয়া স্ট্রিটের জহুরি বাজারের ব্যবসায়ী মহম্মদ সেলিমের (৫৫) দোকানে লুঠ হয়। শ্বাসরোধ করে খুন করা হয় সেলিমকে। পুলিশ জানিয়েছে, রাজাবাজারের বাসিন্দা সেলিম প্রায় তিন দশক ধরে রত্নের ব্যবসা করতেন।
এই ঘটনায় মঙ্গলবার রাতেই স্থানীয় আর এক ব্যবসায়ী, একবালপুরের বাসিন্দা আরশাদকে আটক করে জোড়াসাঁকো থানার পুলিশ। জেরায় আরশাদ প্রথমে অপরাধ কবুল করেননি। পুলিশের দাবি, আরশাদকে লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগে নিয়ে গিয়ে চাপ দিতেই ভেঙে পড়েন তিনি। শেষমেশ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সরকারি ভাবে গ্রেফতার করা হয় আরশাদকে।
কেন পরিচিত ব্যবসায়ীর দোকানে লুঠ করলেন আরশাদ?
পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, কিছু দিন ধরেই আরশাদের ব্যবসা ভাল চলছিল না। এর পরেই তিনি সেলিমের সঙ্গে রত্ন ব্যবসায় নামেন। নানা রকমের রত্ন এবং তার দাম সম্পর্কেও অবহিত হন। ব্যবসায় মন্দার কারণে আর্থিক সঙ্কটেও
পড়েছিলেন আরশাদ।
এই পরিস্থিতিতে ওই এলাকার নামী ব্যবসায়ী সেলিমের দোকানেই হানা দেওয়ার ছক কষেন তিনি। আরশাদের ধারণা ছিল, বেশ কিছু নগদ টাকা ও দামি রত্ন হাতাতে পারলে একসঙ্গে প্রচুর টাকা চলে আসবে তাঁর হাতে। চটজলদি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই একবালপুরের তিন যুবকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। ওই তিন জনের মধ্যে এক জন কলের মিস্ত্রি, অন্য জন রঙের মিস্ত্রি। আগে তাঁরা কাজের সূত্রে ভিন্ রাজ্যে থাকতেন। কয়েক মাস আগে শহরে ফিরেছিলেন। লালবাজারের এক গোয়েন্দা-কর্তার দাবি, ‘‘টাকার লোভে পড়েই ওই তিন জন আরশাদের সঙ্গে এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, লুঠের ব্যাপারে মনস্থির করার পরে নিখুঁত ছক সাজিয়েছিলেন আরশাদ। সঙ্গীদের আসানসোলের ব্যবসায়ী সাজিয়ে তিনি প্রথমে সেলিমের কাছে পাঠান। প্রাথমিক কথাবার্তার পরে সোমবার রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ রত্ন কিনতে আসার কথা জানান সেলিমের সঙ্গীরা। তদন্তকারীদের একাংশ বলছেন, জহুরি বাজারের হাল-হকিকত জানতেন আরশাদ। ফলে রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ জাকারিয়া স্ট্রিটের ওই এলাকার নিরাপত্তা যে ঢিলেঢালা থাকে এবং সে সময় সেলিম দামি রত্ন নিয়ে যে অরক্ষিত থাকবেন, সেই ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন তিনি। সেই মতোই সেলিমের দোকানে হানা দেয় অভিযুক্তেরা।
ওই ব্যবসায়ীর মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে দেওয়ার ফলে দমবন্ধ হয়ে মারা যান তিনি। এক গোয়েন্দা-কর্তা বলছেন, ‘‘পরিচিত হওয়ায় নিজে সরাসরি লুঠ করতে যাননি আরশাদ। তবে ঘটনার সময়ে এলাকাতেই ছিলেন।’’
পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, আটক করার পরে আরশাদ প্রথমে জানিয়েছিলেন, সোমবার রাতে তিনি জাকারিয়া স্ট্রিটে ছিলেন না। অথচ ঘটনার পরে সেলিমের লুঠ হওয়া ফোনে যে সিমকার্ড ভরা হয়েছিল, তার সূত্র ধরে তদন্তকারীরা নিশ্চিত ছিলেন যে এই ঘটনায় আরশাদের যোগ রয়েছে। ঘটনার সময়ে আরশাদের মোবাইল-টাওয়ার লোকেশন জোড়াসাঁকো এলাকাতেই ছিল। ফলে আরশাদ যে অপরাধ করার পরে তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করতে চাইছেন, সেটাও বুঝে যান গোয়েন্দারা। ‘‘সেই সব সূত্র সামনে রেখে চাপ দিতেই আর নিজেকে আড়াল করতে পারেননি ওই ব্যবসায়ী,’’— বলছেন এক গোয়েন্দা কর্তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy