সাল ২০১৩। ধস নামল ঢাকুরিয়া উড়ালপুলে। তার পরেই শহরের একাধিক সেতুর হাল জানতে রেলের সহযোগী সংস্থা ‘রাইট্স’-এর সাহায্য চাইল রাজ্য সরকার। পরিদর্শন করে রাইট্স পুরসভাকে জানিয়ে দিল, বেহাল দশা অরবিন্দ সেতুর। কোথায় কোথায় অসুখ, তা নির্ণয় করে সুপারিশও জমা দিল তারা।
সাল ২০১৬। উত্তর কলকাতার খন্না মোড় থেকে উল্টোডাঙামুখী, উত্তর কলকাতার সঙ্গে পূর্ব কলকাতার অন্যতম প্রধান যোগাযোগকারী ওই সেতুর নীচে থাকা লোহার কাঠামোয় মরচে ধরেছে। দুর্বল হয়ে পড়েছে লোহার ক্ষমতা। অথচ তার উপর দিয়েই নিত্য যাতায়াত করছে ভারী যানবাহন। রাইট্স-এর ইঞ্জিনিয়ারেরা বলছেন, অরবিন্দ সেতুতে ভয়ঙ্কর কোনও দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে যে কোনও সময়ে। এবং একই হাল মধ্য কলকাতার সঙ্গে পূর্ব কলকাতার প্রধান সংযোগ বেলেঘাটা সেতুরও।
তিন বছরেও ছবিটা পাল্টাল না কেন? পুরসভার রাস্তা দফতরের এক আধিকারিকের ব্যাখ্যা, অরবিন্দ সেতু কেআইটি-র অধীনে। তাই ওই সেতু নিয়ে পুরসভার কোনও মাথাব্যথা নেই। যা শুনে রাইট্স কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, ঢাকুরিয়া উড়ালপুলও তো কেএমডিএ-র অধীনে। সেখানে তো পুর-প্রশাসনকেই সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা গিয়েছে। তা হলে অরবিন্দ সেতুর ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে কেন? এই সব চাপান-উতোরের জন্যই অঘটন ঘটে, বলছেন বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারেরা।
রাইট্স-এর গ্রুপ জেনারেল ম্যানেজার (হাইওয়ে ও ব্রিজ) তরুণ সেনগুপ্তের দাবি, ২০১৩ সালে ঢাকুরিয়া উড়ালপুলে ধস নামার পরে কলকাতা পুরসভার ডিজি (রাস্তা) সৌমিত্র ভট্টাচার্য তাঁদের অরবিন্দ সেতুর হাল কেমন দেখতে অনুরোধ করেন। তরুণবাবু বলেন, ‘‘ডিজি-র অনুরোধেই আমাদের বিশেষজ্ঞ দল সেটি পরীক্ষা করে দেখে।’’ রাইট্স সূত্রে খবর, ওই সেতুর হাল মোটেই ভাল নয়। শীঘ্রই কাঠামো বদলানো দরকার। বিষয়টি তখনই তাঁরা পুরসভা ও কেআইটি-কে জানান।
ধুঁকছে যারা। এমনই হাল দুই সেতুর। সোমবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
সৌমিত্রবাবু কিন্তু পুরো বিষয়টিই অস্বীকার করেছেন। যা শুনে হতবাক রাইট্স ও কেআইটি-র একাধিক ইঞ্জিনিয়ার। তাঁদের কথায়, ‘‘এতে অস্বীকার করার মতো কী আছে, বুঝতে পারলাম না।’’
পুরসভার ডিজি (রাস্তা) বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও কেআইটি-র একাধিক অফিসার তা স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁরা জানান, এক বার নয়, রাইটসকে দিয়ে দু’বার সমীক্ষা করানো হয়েছে। পুরসভার ডিজি-ও (রাস্তা) ঘটনাস্থলে ছিলেন। কেআইটি সূত্রের খবর, বছরখানেক আগে অবশ্য এ বিষয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার-অধ্যাপকদের মতামত চাওয়া হয়েছিল। তার পরে আর কী হয়েছে, তা জানা নেই রাইট্স-এরও।
কিন্তু খুব শীঘ্রই যে ওই সেতুর কাঠামো বদল ও মেরামতির প্রয়োজন, তা জানাতে ভোলেননি রাইট্স-এর বিশেষজ্ঞেরা। পুরসভার এক স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার বলেন, ‘‘কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণে ক্যানাল ইস্ট, ক্যানাল সাউথ-এর উপরে থাকা প্রায় প্রতিটি সেতুই বহু আগের তৈরি। দীর্ঘদিন ওই সব সেতুতে কাজ হয়নি।’’ ফলে অঘটন রুখতে হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বলে মনে করছেন তিনি।
ওই পুর-ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, ‘‘অরবিন্দ সেতুর মতোই হাল সেল্স ট্যাক্স অফিস ছাড়িয়ে বেলেঘাটামুখী রাস্তায় খালের উপরের সেতুটির। তার নীচে তাকালে ভয় লাগে। সিমেন্টের আস্তরণ খসে বেরিয়ে পড়েছে লোহার কাঠামো। দিনের পর দিন তাতে মরচে ধরা বাড়ছে। কমে গিয়েছে লোহার ক্ষমতা। দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে এই সেতুতেও।’’ তাঁর দাবি, কার সেতু কে দেখবে, এ সব না ভেবে এখনই কাজে নামা দরকার। ওই ইঞ্জিনিয়ার বলেই ফেলেন, ‘‘শহর সৌন্দর্যায়নে সেতুর উপরে নীল-সাদা রং করা, রাস্তায় বাড়তি আলোর জন্য এত খরচ হচ্ছে। কিন্তু সেতুর কাঠামোর দিকে সে ভাবে নজর নেই কেন, বোঝা যাচ্ছে না।’’
বাস্তবেও দেখা গিয়েছে, অরবিন্দ সেতু এবং বেলেঘাটা সেতুর উপরটা দেখে বোঝার উপায় নেই ব্রিজের নীচের কাঠামো কতটা বেহাল। দুই ক্ষেত্রেই স্থানীয় কাউন্সিলরদের বক্তব্য, পুরসভার সংশ্লিষ্ট দফতর সব জেনেও কোনও অজ্ঞাত কারণে চুপ করে রয়েছেন। শহরবাসীর নিরাপত্তার কথা ভেবে এখানে পুর-প্রশাসনের অবিলম্বে উদ্যোগী হওয়াটাই জরুরি বলে মনে করছেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy