Advertisement
০৯ মে ২০২৪
Kolkata

দিল্লি, মুম্বইয়ের থেকে অনেক স্বস্তিতে আছেন কলকাতার বস্তিবাসীরা

গ্রামাঞ্চল বা ভিনরাজ্য থেকে কাজ বা রুটিরুজির সন্ধানে মানুষ বরাবরই শহরে এসেছে। সেই ধারা এখনও অব্যাহত। এঁদের বেশির ভাগই গরিব, দক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিক। শহরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের (যেমন, ব্যবসাবাণিজ্য এবং শিল্পোৎপাদন) বিস্তার ঘটাতে এঁদের শ্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তুলনামূলক ভাবে ভাল আছেন কলকাতার বস্তিবাসীরা।

তুলনামূলক ভাবে ভাল আছেন কলকাতার বস্তিবাসীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৬ ১৩:১৪
Share: Save:

গ্রামাঞ্চল বা ভিনরাজ্য থেকে কাজ বা রুটিরুজির সন্ধানে মানুষ বরাবরই শহরে এসেছে। সেই ধারা এখনও অব্যাহত। এঁদের বেশির ভাগই গরিব, দক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিক। শহরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের (যেমন, ব্যবসাবাণিজ্য এবং শিল্পোৎপাদন) বিস্তার ঘটাতে এঁদের শ্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এই বহিরাগত মানুষদের জীবন তাতে কতটা বদলায়? তাঁদের জীবিকা ও জীবনযাপনের মান কতটা উন্নত হয়? এই বিষয়টিই খতিয়ে দেখতে ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ (সিআরজি) গত দু’বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে নিয়ে এসেছে।

কলকাতা, মুম্বই ও দিল্লি এই তিন মহানগরীতে অভিবাসী বা বহিরাগত মানুষদের অবস্থা খতিয়ে দেখা হয়েছে এই গবেষণায়। সেই সঙ্গে্ কিছুটা সংক্ষেপে হলেও বিহারের কোশি নদীর অববাহিকা এলাকা এবং পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি শহরকেও গবেষণার আওতায় আনা হয়েছে। কারণ, দেখা গিয়েছে প্রতি বছরই বন্যায় আক্রান্ত কোশি নদীর অববাহিকা অঞ্চল থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ জীবিকার সন্ধানে দিল্লিতে হাজির হচ্ছেন। অন্য দিকে, শিলিগুড়ি শহর কোনও শিল্পশহর না হয়েও তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানো বহিরাগত বা অভিবাসী মানুষদের ট্রানজিট টাউন হিসাবে আয়তনে বেড়ে চলেছে।

সরকারি হিসাবেই জানা যায় যে কলকাতায় ব্রিটিশ আমলেই বস্তি তৈরির সূত্রপাত হয় শহর আর তার উপকণ্ঠে গড়ে ওঠা কলকারখানার শ্রমিকদের বাসস্থান হিসাবে। চটকল, সুতাকল ও ইঞ্জিনিয়ারিং- প্রধানত এই তিন শিল্পে কাজের জন্যই গত শতাব্দীতে কলকাতায় রাজ্যের নানান জেলা থেকে এবং প্রতিবেশী রাজ্যগুলি থেকে অভিবাসীরা এসে ভিড় করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে এই তিন শিল্পেই রুগ্নতার কারণে কাজের সুযোগ যেমন কমেছে, তেমনই অভিবাসী শ্রমিকদের আসার হারও কমেছে। ২০১১ সালের জনগণণায় দেখা যাচ্ছে, কলকাতায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির বদলে উল্টোমুখী হয়ে কমছে। ২০০১ সালে কলকাতার প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ছিল ২৪,৭১৮ জন। ২০১১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৪,২৫৮ জনে।

মনে রাখতে হবে, তা সত্ত্বেও প্রতি দিনই কিছু না কিছু মানুষ কলকাতায় হাজির হচ্ছেন কাজের সন্ধানে। যেমন, শিয়ালদহ স্টেশনে প্রতিদিন গড়ে ২-৩ জন নাবালক এসে ঠাঁই নিচ্ছে। নমুনা সমীক্ষায় দেখা গেছে, এদের ৮০ শতাংশই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে আসছে। বাকি ২০ শতাংশ আসছে প্রতিবেশী ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা, অসম এবং এমনকী দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশ থেকেও। প্রধানত দারিদ্র ও বাড়িতে নিপীড়নের তাড়নাতেই এরা ঘর ছাড়ছে।

অন্য দিকে, প্রচলিত শিল্পে কাজের সুযোগ কমলেও নির্মাণশিল্পে কাজের জন্য পশ্চিমবঙ্গেরই মালদহ, মুর্শিদাবাদ, দুই ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুর থেকে অনবরত অভিবাসী শ্রমিকরা কলকাতায় আসছেন। তবে এঁদের একটা বড় অংশই নির্মাণের মরসুমে কলকাতায় থাকেন, কাজ বন্ধ থাকলে নিজেদের জায়গায় ফিরে যান।

কলকাতা মহানগরীর প্রতি দিনের জঞ্জাল ও পয়ঃপ্রণালী সাফ করার কাজে যুক্ত সাফাই কর্মীরা বেশির ভাগই বিহার, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান প্রভৃতি রাজ্যের মানুষ, যাঁরা ব্রিটিশ আমল থেকেই বংশানুক্রমে এই শহরে রয়ে গিয়েছেন। এরা তথাকথিত 'নিচু জাত' ভাঙ্গি, মেথর, বাল্মিকী, হেলা প্রভৃতি। অন্য দিকে, রাজমিস্ত্রি ও সূত্রধররা প্রধানত মালদহ, মুর্শিদাবাদের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। আয়ারা প্রধানত দুই ২৪ পরগনা থেকে নিত্যযাত্রী হয়ে কলকাতায় কাজ করতে আসেন। কিন্তু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সদের বড় অংশই কেরল, মণিপুর, অন্ধ্রপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্য থেকে আসেন। এই নার্সদের একটা বড় অংশ চাকরির ক্ষেত্রে আরও বড় সুযোগের খোঁজে কলকাতাকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসাবে ব্যবহার করেন।

দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র মুম্বই বরাবরই গোটা দেশ থেকে অভিবাসীদের আকর্ষণ করেছে। ১৯৬১ সালের জনগণনার হিসাবে মুম্বইয়ে কর্মরত মানুষদের ৮৪ শতাংশই বহিরাগত শ্রমিক। ১৯৭১ সালের জনগণনাতেও দেখা যাচ্ছে, মুম্বইয়ের তিন ভাগের দুই ভাগ বাসিন্দার জন্মই মুম্বইয়ে হয়নি, অন্যত্র হয়েছে। ২০০১ সালের জনগণনায় মুম্বইয়ের ৪৭.৩ শতাংশ মানুষকেই অভিবাসী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মহারাষ্ট্রের যে মানুষেরা মুম্বইয়ে জীবিকার জন্য আসছেন, তাঁরা প্রধানত বস্ত্রশিল্পে কাজ করেন। নির্মাণশিল্পে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক আসেন অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে। সেখানকার ব্যবসাবাণিজ্যে প্রধানত গুজরাটিরাই প্রবল, সঙ্গে যদিও সিন্ধ্রি ও মাড়োয়ারিরাও রয়েছেন। এছাড়াও ব্যবসাবাণিজ্যে পার্শি, বোহরা, খোজা ও মেমন সম্প্রদায়ের লোকজন রয়েছেন। উত্তরপ্রদেশের আনসারি (মুসলমান) সম্প্রদায়ের মানুষজন প্রধানত বস্ত্রশিল্পে দক্ষশ্রমিক হিসাবে যুক্ত। এছাড়া বেশিরভাগ মুসলমান শ্রমিকই চর্মশিল্প, জরিশিল্প, গহনাশিল্প, বেকারি প্রভৃতিতে যুক্ত। মালাবার উপকূলের মুসলমানরা অসংখ্য ছোট বড় মাঝারি হোটেল ও রেস্তোরাঁ পরিচালনার কাজে যুক্ত। অন্য দিকে, বিহার ও উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা শ্রমিকরা প্রধানত ট্যাক্সি ও অটো চালানোর পেশায় যুক্ত।

এই বিশাল শ্রমিকবাহিনীর বাসস্থান মুম্বই শহরের বিভিন্ন বস্তি। ২০০১ সালের জনগণনা অনুসারে মুম্বই শহরের মোট জমির মাত্র ছয় শতাংশ এলাকা নিয়ে তৈরি বস্তিতে থাকেন শহরের ৫৪ শতাংশ বাসিন্দা। এত অল্প জায়গায় শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ থাকতে বাধ্য হওয়ার পরও কিন্তু তাঁদের নিস্তার নেই। কারণ, সরকারি উদ্যোগে ক্রমাগত বস্তি উচ্ছেদ চলছে। ২০০৩ সালে মুম্বই শহরকে একটি 'ওয়ার্ল্ড ক্লাস সিটি'তে পরিণত করার জন্য 'ভিশন মুম্বই' ঘোষণা করা হয়েছে। ৪০০০ কোটি ডলার বিনিয়োগে মুম্বইকে একটি আন্তর্জাতিক মানের মহানগরীতে পরিণত করা হবে। তার অঙ্গ হিসাবে বস্তি উন্নয়নের নামে বস্তি এলাকার ৬০ শতাংশ জমি নিয়ে তাকে বাণিজ্যিক কাজের উপযুক্ত করে তোলা হবে। বাস্তবে যার অর্থ, বস্তি উচ্ছেদ। ২০০৪-৫ সালেই মুম্বই শহরের বুক থেকে ৯০ হাজার বস্তি উচ্ছেদ করা হয়। এই বস্তি উচ্ছেদ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।

মুম্বইয়ের ৫৪ শতাংশ মানুষই যদি বস্তিবাসী হন, তা হলে রাজধানী দিল্লির ক্ষেত্রে সংখ্যাটা আরও বেশি। ৬৫ শতাংশ। এঁদের বাস বিভিন্ন ঝুগ্গি ঝোপড়ি কলোনিতে। তবে গত এক দশকে দিল্লিতে বহিরাগতদের আসার হার নিম্নমুখী। শহরের ১৬ শতাংশ মানুষই বহিরাগত শ্রমিক। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উত্তরপ্রদেশের, তার পরেই বিহারের মানুষ। বিহারের অভিবাসীদের মধ্যে আবার কোশি অববাহিকার বন্যাপ্রবণ জেলাগুলি থেকে আসা মানুষই বেশি। এই ঝুগ্গি ঝোপড়ি বাসিন্দাদের মধ্যে অন্তত আট লক্ষ মানুষ ধারাবাহিক উচ্ছেদ ও স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনীতিকদের হাতে হয়রানির শিকার। মুম্বইয়ের মতোই দিল্লির সৌন্দর্যায়নের তাড়নায় এই অভিবাসী মানুষরা ক্রমাগত উপেক্ষা ও হয়রানির শিকার হয়ে চলেছেন। সরকারি উপেক্ষার প্রমাণ মেলে দিল্লির নগরোন্নয়ন দফতরের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ থেকে। গত পাঁচ বছরে এই বাজেটে বরাদ্দ কমতে কমতে ১৪ শতাংশ থেকে এখন ৯ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।

অভিবাসীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সম্পর্ক যে অনেক সময়েই তিক্ত সংঘর্ষে পরিণত হয়, তার নজির বহু। কলকাতায় বহিরাগতরা যে ব্রিটিশ আমল থেকেই নিজেরা কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই বসবাস করতে বাধ্য হয়েছেন, তা অর্থবহ। মুসলমানদের জন্য কলকাতায় এবং মুম্বই, দিল্লিতেও হিন্দু এলাকায় বাড়ি ভাড়া পাওয়া যে দুষ্কর, তা বার বার দেখা গিয়েছে। আর মুম্বইয়ে অভিবাসী শ্রমিকরা তো ধারাবাহিকভাবে শিবসেনার আক্রমণের শিকার। কখনও তা মুসলমান শ্রমিক, কখনও বিহার থেকে আসা শ্রমিকদের আক্রমণের লক্ষ্য হিসাবে বেছে নেয়।

তবে বস্তি উচ্ছেদের যে ধারা মুম্বই ও দিল্লিতে অব্যাহত, তা কলকাতায় সরকারি উদ্যোগেই আটকে গেছে। ১৯৮১ সালে রাজ্য সরকার ঠিকা টেন্যান্সি অ্যাক্ট সংশোধন করে কলকাতার যাবতীয় বস্তি অধিগ্রহণ করে। ফলে, বস্তি উচ্ছেদ করে সেই জমি বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহারের যে প্রবণতা সরকারি মদতে মুম্বই ও দিল্লিতে চলছে, তা কলকাতায় করা যায়নি।

আরও পড়ুন:
অপুষ্টির ‘সন্ত্রাস’ কুরে কুরে খাচ্ছে কলকাতার বস্তির শৈশব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Slum Slum of Kolkata Rajat Roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE