Advertisement
১৭ মে ২০২৪

কপালের মাংস কেটে কৃত্রিম নাক, নতুন জীবন মহিলার

মত্ত স্বামীর অত্যাচার চলত নিত্যদিন। সেই স্বামী এক রাতে ধারালো ছুরি দিয়ে গোটা নাকটাই কেটে দিয়েছিল পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরের শিউলি হালদারের (নাম পরিবর্তিত)। প্রথমে জেলা হাসপাতাল। সেখান থেকে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ।

প্রতিস্থাপনের আগে ও পরে। — নিজস্ব চিত্র

প্রতিস্থাপনের আগে ও পরে। — নিজস্ব চিত্র

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৬ ০১:২৩
Share: Save:

মত্ত স্বামীর অত্যাচার চলত নিত্যদিন। সেই স্বামী এক রাতে ধারালো ছুরি দিয়ে গোটা নাকটাই কেটে দিয়েছিল পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরের শিউলি হালদারের (নাম পরিবর্তিত)। প্রথমে জেলা হাসপাতাল। সেখান থেকে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ। চিকিৎসায় প্রাণে বাঁচলেও বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্কটা পুরোপুরি ছিন্ন করে দিয়েছিলেন শিউলি। চেহারার বিকৃতি তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল পুরোপুরি অন্ধকার একটা জগতে। তাঁকে নতুন চেহারা দিয়ে ফের মূলস্রোতে ফেরাল কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতাল।

স্বামীর আক্রমণে গুরুতর জখম শিউলি প্রথমে যখন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছন, তখন তাঁকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন আশপাশের রোগীরা। গোটা মুখ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। নাকের জায়গায় কিছু নেই, শুধু একটা গভীর ক্ষত। প্রায় অচেতন হয়ে পড়েছিলেন শিউলি। সেখানকার চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ওই পরিস্থিতি থেকে শিউলির এখনকার এই রূপান্তর তাঁদের কাছেও অভাবনীয়।

এসএসকেএমের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরা কপাল থেকে মাংস কেটে তা দিয়ে নাক তৈরি করে প্রতিস্থাপন করেছেন। চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে বলে ‘ইন্ডিয়ান রাইনোপ্লাস্টি’ (সুশ্রুত)। অস্ত্রোপচারের নামের সঙ্গে এ ভাবে সুশ্রুতের নাম যোগ হয়েছে কেন? যে চিকিৎসক অস্ত্রোপচারটি করেছেন, সেই অরিন্দম সরকার বলেন, ‘‘এই পদ্ধতির মূল আবিষ্কর্তা সুশ্রুত। সেই আমলে রাজারা অনেক প্রজাকেই হুকুম না মানার শাস্তি হিসেবে নাক কেটে নিতেন। সেই সময়ে সুশ্রুত এই অস্ত্রোপচার চালু করেন। সেই কারণেই অস্ত্রোপচারের নামের সঙ্গে সুশ্রুতের নাম জড়িয়ে গিয়েছে।’’

শিউলির মোট দু’টি অস্ত্রোপচার হয়েছে। প্রথমে কপাল থেকে মাংস নিয়ে তা থেকে নাকের মতো আকৃতি গড়ে তা লাগানো হয়েছিল কপাল ও ঠোঁটের মাঝখানের অংশে। এর ভিতরে একটি টিউবের মতো জিনিস ভরে দেওয়া হয়েছিল। কিছু দিন পরে দ্বিতীয় অস্ত্রোপচারে টিউবটি বার করে নেওয়া হয়। অস্ত্রোপচারের পরে সংক্রমণের ভয় ছিল। কিন্তু তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন তিনি। আপাতত শিউলি সম্পূর্ণ সুস্থ বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। কপাল থেকে মাংস কেটে নেওয়া হয়েছিল বলে সেখানে সেলাইয়ের দাগ রয়েছে। তবে পরে তা মিলিয়ে যাবে বলেই আশ্বাস দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

অরিন্দমবাবু বলেন, ‘‘অনেক ধরনের অস্ত্রোপচারই করতে হয়। কিন্তু এটা আমাদের কাছেও একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ওই ভদ্রমহিলা পুরোপুরি মানসিক অবসাদে চলে গিয়েছিলেন। দীর্ঘ দিন এমন চলতে থাকলে বড় কোনও ক্ষতি হয়ে যেতে পারত। যে ভাবেই হোক, ওঁর চেহারার বিকৃতি দূর করাটাই লক্ষ্য ছিল। সেটাতে আমরা সফল।’’

শিউলিদেবী জানিয়েছেন, শুধু চেহারার বিকৃতি দূর হওয়া নয়, ওই অস্ত্রোপচার তাঁর আত্মবিশ্বাসটাও ফিরিয়ে দিয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘আর স্বামীর ঘরে ফিরব না। মায়ের সঙ্গে থাকব। নিজে পরিশ্রম করে রোজগার করব। আমার জীবনের সিদ্ধান্ত এ বার থেকে আমিই নেব।’’

এসএসকেএমের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এর আগেও তাঁরা অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছেন। ধান কাটার যন্ত্রে এক ব্যক্তির পুরুষাঙ্গ বাদ গিয়েছিল। হাত থেকে মাংস কেটে পুরুষাঙ্গ তৈরি করেছিলেন তাঁরা। সেই অস্ত্রোপচারের কথা বিদেশের কয়েকটি জার্নালেও ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল। এ ছাড়া, অ্যাসিড-আক্রান্তদের চেহারার বিকৃতি কাটাতে প্লাস্টিক সার্জারি তো বহু হয়। কিন্তু এই অস্ত্রোপচারটি সব দিক থেকেই ছিল আলাদা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Critical nose operation SSKM
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE