তনুশ্রী রায়মজুমদার
নামী চিকিৎসকের উপরে পুরোপুরি আস্থা রেখেছিলেন প্রসূতি ও তাঁর পরিবার। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রসূতির ‘পলিহাইড্রামনিওস’ বা পেটের মধ্যে জল বেড়ে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা ছিল। চিকিৎসক সে সম্পর্কে ওয়াকিবহালও ছিলেন।
আট মাসের গর্ভাবস্থায় সেই প্রসূতি যখন শ্বাসকষ্ট সহ্য করতে না পেরে চিকিৎসককে অস্ত্রোপচার করার অনুরোধ জানান তখন ‘অযথা উদ্বিগ্ন হওয়া’র জন্য তাঁকে ধমক দিয়েছিলেন ডাক্তারবাবু। অভিযোগ, প্রসবের দেরি আছে জানিয়ে প্রসূতিকে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক চিকিৎসকের হাতে ছেড়ে দিয়ে আচমকাই চলে যান বিদেশের সেমিনারে যোগ দিতে।
তিনি চলে যাওয়ার পরেই অবস্থার অবনতি হয় প্রসূতির। প্রয়োজন হয় জরুরি অস্ত্রোপচারের। তার পর আর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেননি প্রসূতি ও তাঁর সন্তান। হাসপাতালেই মৃত্যু হয় দু’জনের।
অভিযোগ, এই পুরো সময়ে ওই চিকিৎসকের সঙ্গে ফোনেও যোগাযোগ করা যায়নি। দেশে ফিরেও রোগীর পরিজনদের সঙ্গে দেখা করেননি তিনি। এ দিকে, বেসরকারি হাসপাতালের বিলে অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসকদের তালিকায় জ্বলজ্বলে অক্ষরে সেই ডাক্তারবাবুর নামে ফি বাবদ কয়েক হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে! গোটা ঘটনায় রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলে চিকিৎসায় গাফিলতি ও হাসপাতালের বিলিং ব্যবস্থায় মারাত্মক কারচুপির অভিযোগ দায়ের করেছে তনুশ্রী রায়মজুমদার নামে মৃতার পরিবার।
অভিযোগকারীরা প্রশ্ন তুলেছেন, রোগী এক জন চিকিৎসককে ভরসা করে তাঁর কাছে শিশুর ডেলিভারি করাবেন মনস্থ করে দেখাতে যান। চিকিৎসকও টানা আট মাস তাঁকে দেখেন। আচমকা সেই চিকিৎসক ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থার ওই প্রসূতিকে অন্য চিকিৎসকের হাতে ছেড়ে যান কী করে? দ্বিতীয়ত, যে চিকিৎসক প্রসবকালীন অস্ত্রোপচারের সময়ে উপস্থিতই নেই তাঁর নামে কী করে ৮ হাজার টাকার বিল হয়?
রোগীর পরিজনদের কথায়, বাগুইআটির বাসিন্দা বছর তিরিশের তনুশ্রী গর্ভাবস্থার প্রথম থেকেই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বাণীকুমার মিত্রের কাছে দেখাতে শুরু করেন। তনুশ্রী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। আল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে দেখা গিয়েছিল, সময়ের তুলনায় গর্ভস্থ শিশু আকারে বড় ও তাঁর পেটে জল বেশি জমেছিল। ফলে তনুশ্রীর নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছিল। সারা গা ফুলে গিয়েছিল।
তনুশ্রীর বাবা দীপেন মজুমদার ও স্বামী অর্ণব রায়ের কথায়, ৩০ জুন বেহালার ক্লিনিকে ওই চিকিৎসককে দেখাতে গিয়ে তনুশ্রী বার বার অস্ত্রোপচার করার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, প্রয়োজন নেই। সে দিনই প্রথম তিনি জানান, তিনি সেমিনারে লন্ডন যাচ্ছেন। ফিরে ৯ জুলাই অস্ত্রোপচার করবেন। এর মাঝে প্রয়োজনে শ্যামল নামে এক চিকিৎসককে ফোন করতে বলেন ও প্রেসক্রিপশনের এক কোণে একটা ফোন নম্বর লিখে দেন। শ্যামলের পদবী বা তাঁর ডাক্তারির কী ডিগ্রি রয়েছে, কিছুই তিনি জানাননি বলে অভিযোগ। দীপেনবাবুর কথায়, ‘‘এই শ্যামলের ব্যাপারে কখনও তিনি কিছু জানাননি বা আমাদের সঙ্গে পরিচয় করাননি। তাঁকে বিদেশ যেতে হতে পারে এমনও বলেননি।’’
চিকিৎসক বিদেশ যাওয়ার পরেই তনুশ্রীর অবস্থার অবনতি হয় ও ওই চিকিৎসক শ্যামল দেবনাথের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে নাগেরবাজারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ৫ জুলাই চিকিৎসক শ্যামল দেবনাথ ও পার্থরঞ্জন দাস তনুশ্রীর অস্ত্রোপচার করেন। অস্ত্রোপচারের সময়ে গলায় নাড়ি জড়িয়ে সদ্যোজাতের মৃত্যু হয়। তনুশ্রীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। ৯ জুলাই তাঁকে সল্টলেকের এক হাসপাতালের আইসিসিইউতে ভর্তি করা হয়। সে দিন বাণীকুমারবাবু কলকাতায় ফিরলেও রোগীর পরিজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি বলে অভিযোগ।
সল্টলেকের হাসপাতালে দু’বার তনুশ্রীর অস্ত্রোপচার হয়। সেখানে চিকিৎসকেরা জানান, অস্ত্রোপচারের সময়ে তনুশ্রীর তলপেট, জরায়ুর বহু শিরা-উপশিরা ছিঁড়ে মারাত্মক রক্তক্ষরণ হয়েছে। ২৭ জুলাই সেই ক্ষত থেকে সংক্রমণে তাঁর মৃত্যু হয়।
বাণীকুমার মিত্রের যুক্তি, ‘‘এক জন চিকিৎসকের পক্ষে সব সময়ে কলকাতায় থাকা সম্ভব নয়। তাঁর কোনও প্রয়োজন আসতেই পারে। তখন ওই চিকিৎসকের টিমের অন্যদেরই দায়িত্ব দেওয়া হয়।’’ প্রশ্ন উঠেছে যে, ডাক্তারবাবুর যে একটি টিম আছে, তাতে অন্য ডাক্তারেরা রয়েছেন ও তাঁর অনুপস্থিতিতে সেই চিকিৎসকদের হাতেই অস্ত্রোপচার হতে পারে— রোগীর বাড়ির লোককে তা বলা হয়নি। ফলে টিমের অন্য ডাক্তােররা কী রকম, তা বাড়ির লোক বা রোগী জানবেন কী করে? বাণীকুমার মিত্রের জবাব, ‘‘এটা আলাদা করে বলার কী আছে? এ সব তো রোগীরই জিজ্ঞাসা করা উচিত।’’
বিদেশে থাকা স ত্ত্বেও হাসপাতালের বিলে অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসকদের তালিকায় তাঁর নাম রাখা ও তাঁর ফি-বাবদ ৮ হাজার টাকা নেওয়ার ব্যাপারে তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমার নাম কেন লেখা হয়েছে তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন। আমি কিছু জানি না। কোনও টাকাও নিইনি।’’
ওই হাসপাতালের তরফে ডেপুটি ম্যানেজার সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ‘‘আমাদের ইন্টারনাল বিলে বাণীকুমারের নামে টাকা লেখা হয়েছিল। ওটা আমাদের অভ্যন্তরীণ কিছু হিসেবের ব্যাপার। আসলে রোগীর বাড়ির থেকে ওই টাকা নেওয়া হয়নি। অন্য জায়গায় টাকাটা অ্যাডজাস্ট করে দিয়েছি!’’
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন ‘ফেডারেশন অব অবস্টেট্রিক্স অ্যান্ড গায়নোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’-র সদস্যদের একাংশ ও একাধিক মেডিকো-লিগাল বিশেষজ্ঞের মতে, ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে বিলে ডাক্তারের নাম লিখে টাকা নেওয়া গর্হিত অপরাধ। কিন্তু সংশয়, অস্পষ্টতা ও অজ্ঞতা থেকে যাচ্ছে ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে অন্য ডাক্তারের উপরে রোগীর ভার দেওয়া নিয়ে। এই জন্যই প্রথম থেকে চিকিৎসককে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিকিৎসার বদলে একটা ইউনিট তৈরি করে রোগী দেখতে হবে। ইউনিটের প্রতি চিকিৎসকের সঙ্গে প্রথম দিন থেকে রোগীর পরিচয় করাতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy