বাবা-মায়ের সঙ্গে বাড়িতে সঙ্কল্প। —নিজস্ব চিত্র।
‘সন্তানের পরীক্ষা নিয়ে নিশ্চয়ই আপনারা সকলে খুব চিন্তিত। আমরাও খুব ভাবছি। তবে নিজের সন্তানের কোনও পরীক্ষা খারাপ হলে চিন্তা করবেন না। মনে রাখবেন, ওদের কারও মধ্যে এক জন পেন্টার আছে, যে গণিতের তত্ত্ব ভুলে গেলে কোনও সমস্যায় পড়বে না। কারও মধ্যে এক জন অপূর্ব গায়ক আছে, যে ঐতিহাসিক দু’টো দিন না মনে রাখতে পারলেও ততটাই ভাল গাইবে। আপনারা ছোট ছোট বিষয় নিয়ে মন খারাপ করলে ওদেরও মনটা ভেঙে যাবে। মনে রাখবেন ওদের মধ্যে কারও কারও একটু বিশেষ যত্ন প্রয়োজন পড়ে। তাকে আমরা সকলে মিলে সেই যত্ন দিই। নিজেদের সন্তানদেরও শেখাই সেই যত্ন দিতে। পরীক্ষায় নম্বর তাতে একটু কম হলে, কী বা ক্ষতি? আসুন কয়েক জন ভাল মানুষ তৈরি করি সকলে মিলে।’
স্কুলে পরীক্ষা শুরুর আগে প্রধান শিক্ষিকার লেখা এমনই একটি চিঠি পেয়েছিলেন সিঙ্গাপুরের একটি স্কুলের প্রত্যেক পড়ুয়ার অভিভাবক। সমাজমাধ্যমে এই চিঠি ভাইরাল হয়ে যায় কয়েক দিনেই। প্রধান শিক্ষিকার এই ভাবনার প্রশংসায় হইচই পড়ে যায় সমাজমাধ্যমের বিভিন্ন কমেন্টের বাক্সে।
কিন্তু বাস্তবটা কি সত্যিই এত উদার? যাঁরা সমাজমাধ্যমে প্রশংসা করেন এমন পদক্ষেপের, বাস্তবেও কি তাঁদের আচরণে এতটা সহমর্মিতা থাকে আদৌ? বালিগঞ্জের স্কুলের ছাত্র ডিসলেক্সিক কিশোর সঙ্কল্প দাসের ক্ষেত্রেই যেমন দেখা গিয়েছে, চারপাশটা সমাজমাধ্যমের মতো নয়। নিজের স্কুলের অসহযোগিতায় তার পড়াশোনাই বন্ধ হতে চলেছে বলে অভিযোগ। অনেকের সমস্যা আবার বোঝেন না স্বয়ং অভিভাবকেরাও। দিন কয়েক আগেই যেমন বাগুইআটির এক স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপালকেও তোপের মুখে পড়তে হয়েছে। তিনি এক ছাত্রের মাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ছেলের জন্য স্পেশ্যাল এডুকেটরের সাহায্য নিতে। সেই মায়ের মনে হয়েছিল, স্কুল তাঁর সন্তানকে ‘পাগল’ বলছে। বিশেষ পদ্ধতিতে শিক্ষা পেলে যে ভাল হবে সেই ছাত্রেরই, মাকে বোঝাতে পারেননি শিক্ষিকা। ঠিক যেমন ‘তারে জমিন পর’ ছবির ডিসলেক্সিক শিশু ঈশান অবস্থির বাবাও বুঝছিলেন না তার সমস্যার কথা।
বিশেষ যত্নের প্রয়োজনীয়তা বোঝানোও যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, সে কথা মনে করান স্পেশ্যাল এডুকেটর লিপিকা ভট্টাচার্য। রাজ্য এবং প্রশাসনের তরফে যত দিন না যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হবে স্পেশ্যাল এডুকেশনের বিষয়টিতে, তত দিন আমজনতার ভরসাও বাড়বে না এই পদ্ধতির উপরে। প্রশাসনের তরফে পদক্ষেপ করা হলেই বদলে যেতে পারে এই ছবিটা। তাঁর বক্তব্য, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনও যথেষ্ট সম্মান পায় না বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা। কিন্তু তা-ও সামাজিক অসচেতনতার কারণেই। কোনও শিক্ষকই যে বোঝেন না, তা নয়। কিন্তু অনেকেই জানেন না, কী ভাবে সামলাবেন এমন এক পড়ুয়াকে। বিশেষ পদ্ধতিতে শেখানোর চেষ্টা করলে সহজ হয়ে উঠতে পারে পরিস্থিতিটা, সেই বার্তা এখনও সকলের কাছে পৌঁছয়নি।
মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব মনে করান, আসলে সমস্যাটা মূলস্রোতের মানুষের মানসিকতায়। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল নিজেদের সুবিধে মতো বেঁধে নেন তাঁরাই। তিনি বলেন, ‘‘প্রত্যেককে কেন একটা কাজ একই রকম ভাবে পারতে হবে, সেইটা ভেবে নেওয়াই যে সবচেয়ে বড় ভুল। কোনও শিক্ষক যদি সেই ভাবনা নিয়ে এক জন শিশুকে বড় করেন, তাঁরা সমাজের ভয়ঙ্কর ক্ষতি করতে পারেন।’’ অনিরুদ্ধবাবুর অভিজ্ঞতা বলছে, চারপাশটা বাঁধা ছকের বাইরে কিছুতেই বেরোতে পারছে না। সব স্কুলগুলো এখনও এতটা উদার হয়েই উঠতে পারেনি যে, সেখানে শিশুরা নিজের নিজের মতো করে বেড়ে উঠবে।
যে কোনও মানুষের বড় হয়ে ওঠার পিছনেই অভিভাবকের পাশাপাশি শিক্ষকদের একটা বড় ভূমিকা থাকে বলে মনে করেন মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল। ফলে বাদ বাকি দুনিয়া কোনও শিশুর সঙ্গে যত খারাপ ব্যবহারই করুক না কেন, তা সামলে ওঠার সুযোগ থাকে। কিন্তু শিক্ষক তেমন করলে, মনটা ভেঙে যায়। নীলাঞ্জনাদেবীর সাফ কথা, ‘‘যার বিশেষ যত্ন প্রয়োজন তাকে তো দিতেই হবে। তা নিয়ে কোনও স্কুল সমস্যা করতে পারে নাকি?’’ তাঁর যদিও মত, আগের থেকে চারপাশটা অনেক বদলেছে। কিছুটা সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেছে সমাজ। তবে সঙ্কল্পের মতো ঘটনা চিন্তায় বাড়াচ্ছে তাঁর।
তবে কি গোটা সামাজের ভাবনায় কোনও গোলমাল রয়ে যাচ্ছে? সে চিন্তাই ভয় পাওয়াচ্ছে অনিরুদ্ধবাবুকেও। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কেন একই নিয়মে সকলকে চলতে হবে? কারও মনে আসে না এই প্রশ্নটা?’’ সত্যিই যদি এই প্রশ্ন উঠত সকলের মনে, তবে বুঝি রুপোলি পর্দার ঈশান এবং বাস্তবের সঙ্কল্পদের বেড়ে উঠতে অনেক কম সমস্যা হত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy