Advertisement
০৪ মে ২০২৪

নির্যাতনের লড়াইয়ের মাঝে দেবীর আবাহনে ওঁরা

গত বছর মে মাসে স্কুল থেকে হাওড়ার বাড়িতে ফিরে ঘরের সামনে জটলা দেখে মা রুমি দে-র খোঁজ করে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ঈপ্সিতা দে। পরে অ্যাসিড আক্রান্ত অবস্থায় মাকে পেয়েছিল ওই স্কুলছাত্রী।

দমদম পার্ক নবারুণের প্রতিমা। নিজস্ব চিত্র

দমদম পার্ক নবারুণের প্রতিমা। নিজস্ব চিত্র

সৌরভ দত্ত
শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৫৮
Share: Save:

তারকা বা বিখ্যাত কেউ নন। চার নারী। যাঁদের জীবনের সঙ্গে নির্যাতন শব্দটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। পঞ্চমীর সন্ধ্যায় তাঁদের হাতেই দমদম ক্যান্টনমেন্টের রামলাল দে স্ট্রিটে আবাহন হল দশভূজার।

গত বছর মে মাসে স্কুল থেকে হাওড়ার বাড়িতে ফিরে ঘরের সামনে জটলা দেখে মা রুমি দে-র খোঁজ করে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ঈপ্সিতা দে। পরে অ্যাসিড আক্রান্ত অবস্থায় মাকে পেয়েছিল ওই স্কুলছাত্রী। গৌরীবাড়ির রিঙ্কি সাহা, বারাসতের সবিতা বিশ্বাস একই ভাবে বধূ নির্যাতনে শিকার। মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা ময়না শুধু নিজে নির্যাতিতা নন, একমাত্র মেয়েকেও হারিয়েছেন। স্বামী গায়ে আগুন লাগালেও ময়নার বাবা ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে মেয়েকে থানায় অভিযোগ দায়ের করতে দেননি। এর পর থেকে বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি, দু’তরফ থেকেই মিলত শুধু গঞ্জনা। ময়না জানান, সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী মেয়ে গলায় দড়ি দেয়। দমদমের গোরাবাজারে সঙ্ঘমিত্রা ক্লাবের মণ্ডপে রবিবার সন্ধ্যায় ঈপ্সিতা, রিঙ্কি, সবিতা, ময়নারাই ছিলেন পুজোর উদ্বোধক।

সারা গায়ে অ্যাসিডের ক্ষত নিয়ে লড়াই চালাতে না পেরে মৃত্যু হয় ঈপ্সিতার মায়ের। এ দিন উদ্বোধনী মঞ্চে সেই অত্যাচারের বর্ণনা দেয় কিশোরী। ঈপ্সিতা বলে, ‘‘দাদু, ঠাকুরমা, কাকু, কাকিমা মিলে আমার মাকে মেরেছে। কাকিমা আমাকেও হাত-পা বেঁধে অ্যাসিড খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল। আমাকে ঘিরে মায়ের যে স্বপ্ন ছিল, তা পূরণ করতে চাই। আর ওদের শাস্তি চাই।’’ ১২ বছরের মেয়েকে নিয়ে লড়াই চালাচ্ছে গৌরীবাড়ির রিঙ্কিও। পণের দাবিতে বিয়ের এক মাস পর থেকে শুরু হয় অত্যাচার। ২০০৭ সালে কেষ্টপুরের বাড়িতে গায়ে কেরোসিন ঢেলে রিঙ্কিকে তাঁর স্বামী পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ। রিঙ্কি বলেন, ‘‘যে আমার এত বড় ক্ষতি করল, সে মাত্র ১৪ দিন জেল খেটেছে! আমি চাই, ওর উচিত শিক্ষা হোক।’’

পণপ্রথার শিকার হন সবিতাও। তিনি জানান, সাত বছর আগে এক রাতে প্রচণ্ড মারধরের পরে তাঁর গায়ে শ্বশুরবাড়ির লোকজন আগুন ধরিয়ে দেয়। শরীরের সত্তর শতাংশ পুড়ে যায়। পরে শ্যামনগরের বাড়ি ছেড়ে তিনি হোমে গিয়ে ওঠেন। উদ্বোধনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে সবিতা বলেন, ‘‘এক সময়ে এই চেহারা নিয়ে বেরোতে লজ্জা হত। ভাবতাম, নারীশক্তি নিয়ে এত কথা সবই লোক দেখানো।’’ এর পরে মুখে একরাশ হাসি নিয়ে বলেন, ‘‘অন্য রকম ভাবনার পুরুষেরা যে আছেন, তা ভেবে ভাল লাগছে। আগামী দিনে লড়াইয়ের রসদ পেলাম।’’

সেই মঞ্চেই বিশেষ অতিথি হিসেবে হাজির ছিলেন স্বরাষ্ট্রসচিব অত্রি ভট্টাচার্য, ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার রাজেশ সিংহ। সুবিচার পেতে আইনি সাহায্যে নির্যাতিতাদের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেন স্বরাষ্ট্রসচিব।

চার কন্যার এই অন্য রকম অনুভূতিতে খুশি তাঁদের ‘মেন্টর’ স্বাতী ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, ‘‘এই মঞ্চ থেকে ওঁদের জীবনের লড়াইটা যদি সহজ হয়, সেটাই হবে বড় প্রাপ্তি।’’ ক্লাবের সভাপতি কৌশিক চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই সমাজে আত্মনির্ভর হওয়া খুব জরুরি। সেই ভাবনা থেকেই ঈপ্সিতা, ময়না, রিঙ্কি, সবিতারা আমাদের পুজোর উদ্বোধক।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE