কলকাতা পুরসভার গবেষণাগার। — নিজস্ব চিত্র
চার বছর আগেই ভুলটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল কেন্দ্র। তাতে গুরুত্বই দেয়নি রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। যার নিট ফল— ২০১৬-য় গোটা রাজ্য যখন ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ায় কাঁপছে, তখন এন্টোমোলজিস্ট ও সংশ্লিষ্ট ল্যাবের অভাবে রোগবাহী মশা ও মশাবাহিত রোগ মোকাবিলা মাথায় উঠেছে।
২০১২-র ফেব্রুয়ারি। কলকাতা পুরসভার মশা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংক্রান্ত কাজ খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দেন জাতীয় পতঙ্গবাহিত রোগ প্রতিরোধ কর্মসূচির তৎকালীন অ্যাসিস্ট্যান্ট রিসার্চ অফিসার জ্যোতির্ময় নন্দী। সেই রিপোর্টে পুরসভার এন্টোমোলজিক্যাল ল্যাবের ভূয়সী প্রশংসা করে লেখা হয়েছিল—‘রোগবাহী পতঙ্গ নিয়ে গবেষণা না করলে এবং তাদের খোঁজ না রাখলে কোনও দিনই পতঙ্গ ও পতঙ্গবাহী রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।’
কলকাতা পুরসভাকে অনুসরণ করে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরও যাতে পতঙ্গবাহিত রোগ প্রতিরোধে একই রকম ব্যবস্থা নেয়, সে ব্যাপারে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। কেন্দ্রীয় পতঙ্গবাহী রোগ প্রতিরোধ কর্মসূচির তৎকালীন অ্যাডিশন্যাল ডিরেক্টর জি এস সোনাল ফেব্রুয়ারিতেই রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তাকে চিঠি লেখেন। তাতে জ্যোতির্ময় নন্দীর রিপোর্টের প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়, এন্টোমোলজিস্ট ও সংশ্লিষ্ট ল্যাবরেটরি কতটা প্রয়োজনীয়। জানানো হয়, কলকাতা পুরসভার ল্যাবরেটরির সাহায্যেই ২০১০ থেকে ২০১১-য় এক ধাক্কায় ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়া প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গিয়েছে। সব ধরনের ম্যালেরিয়া কমেছে ৫৭ শতাংশ!
কিন্তু অভিযোগ, এখনও রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের এক জনও এন্টোমোলজিস্ট নেই। স্বাস্থ্য দফতরের পতঙ্গবাহিত রোগের একমাত্র গবেষণা কেন্দ্র ‘স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন’ এ বিভাগটিই লোপ পেয়েছে। সেখানে এন্টোমোলজিস্টের পাশাপাশি ইনসেক্ট কালেক্টরের অস্তিত্বও নেই। ট্রপিক্যালের এক সময়ের উন্নত এন্টোমোলজিক্যাল ল্যাবরেটরি, ইনসেক্টোরিয়াম এবং মশার কলোনির ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে মাত্র।
অথচ ২০১২-য় রাজ্যে মারাত্মক ডেঙ্গি, বছর আড়াই আগে উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিসে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার সময়েও এন্টোমোলজিস্টের আকাল এবং ট্রপিক্যালে ওই বিভাগ লোপ পাওয়া তীব্র সমালোচিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, পুরসভা যদি মাত্র ৪ লক্ষ টাকায় উন্নত এন্টোমোলজিক্যাল ল্যাবরেটরি গড়ে এবং স্বাস্থ্য দফতরের সাহায্য ছাড়াই তিন জন এন্টোমোলজিস্ট রাখতে পারে, রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর বিপুল পরিকাঠামোয় সেটুকু করতে পারছে না কেন?
স্বাস্থ্য দফতরের পতঙ্গবাহিত রোগ প্রতিরোধ বিভাগের একাধিক কর্তার মতে— অর্থাভাব নেই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অর্থখরচে অকৃপণ। তা হলে কেন এত দিনেও ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়াপ্রবণ রাজ্যে এক জনও এন্টোমোলজিস্ট নিয়োগ হবে না? ওই কর্তারা জানান, গত এক বছরে কমপক্ষে তিন বার কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে তা করার অনুরোধ জানিয়েও লাভ হয়নি। ২০১২ সাল থেকে এখনও রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁর উক্তি, ‘‘আমার কিছু বলার নেই’’
পুরসভার মুখ্য পতঙ্গবিদ দেবাশিস বিশ্বাস জানান, বরোগুলিতে র্যাপিড অ্যাকশন টিম ও ফিল্ড ওয়ার্কারেরা আছেন। তাঁরা মশা সংগ্রহ করে ল্যাবে আনেন। মশা চেনান এন্টোমোলজিস্টরা। এক-এক ধরনের মশা মারতে এক-এক রকম কীটনাশক চাই। ল্যাবে মশা চিনলে ফিল্ডে গিয়ে বুঝে কীটনাশক দিতে সুবিধা হয়। তা ছাড়া, রোগবাহী কোনও মশা পরিচিত পরিবেশ ছাড়া অন্যত্র, অসময়ে বংশবিস্তার করছে কি না, পরিচিত বাহক ছাড়া নতুন কোনও প্রজাতির মশা রোগ ছড়াচ্ছে কিনা, কোনও কীটনাশকের প্রতি মশা বা লার্ভার শরীরে প্রতিরোধ জন্মেছে কি না—এ সব জানতেই এন্টোমোলজিক্যাল ল্যাবরেটরি ও এন্টোমোলজিস্ট দরকার।
এন্টোমোলজিস্ট, ইনসেক্ট কালেক্টর ও এন্টেমোলজিক্যাল ল্যাবরেটরির দৌলতেই কলকাতা পুরসভা ২০১৩ সালে শীতকালে ইডেন গার্ডেন্সে জমা নোংরা জলে ম্যালেরিয়ার বাহক অ্যানোফিলিস স্টিফেনসাই মশার লার্ভা খুঁজে পেয়েছিল। জানুয়ারি মাসের একেবারে প্রথম দিকে ওই মশার লার্ভাই মেলে কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরের ছাদে জমে থাকা নোংরা জলে। অথচ সাধারণ নিয়মে ওই মশার শীতকালে নোংরা জলে ডিম পাড়ার কথা নয়। লাগাতার নজরদারি ছাড়া এই স্বভাব পরিবর্তনের হদিস পাওয়া সম্ভব নয়।
দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের এন্টোমোলজি বিভাগের প্রধান এবং ট্রপিক্যালের অধিকর্তা পদে ছিলেন অমিয়কুমার হাটি। তাঁর মতে, এন্টোমোলজিস্টদের মাধ্যমে বছরভর মশা-মাছি নিয়ে ল্যাবরেটরিতে গবেষণা না হলে কোন পতঙ্গের কোন জাতি বছরের কোন সময় বাড়ছে বা কমছে, কোন সময়ে তারা কামড়াচ্ছে, তাদের শরীরের মধ্যে প্যার্যাসাইটের কোনও পরিবর্তন হচ্ছে কিনা, কোনও রোগের নতুন কোনও বাহক হল কি না, কোনও চলতি ওষুধে কোনও বাহকের দেহে প্রতিরোধ জন্মাচ্ছে কি না তা বোঝা অসম্ভব। উদাহরণ হিসেবে তিনি জানান, ডেঙ্গি ছড়ায় মূলত এডিস ইজিপ্টাই মশা। কিন্তু বেশ কিছু দিন যাবৎ এডিস অ্যালবুপিক্টাস মশাকেও ডেঙ্গির বাহক মনে করা হচ্ছে। সল্টলেকে অ্যালবুপিক্টাসই বেশি, ইজিপ্টাই রয়েছে মোট মশার মাত্র ১০ শতাংশ। অথচ সেখানেই এ বছর এত ডেঙ্গি সংক্রমণ। ফলে অ্যালবুপিক্টাস নিয়ে গবেষণা দরকার। কিন্তু রাজ্য সরকারের পরিকাঠামো ভেঙে পড়ায় সেটা হচ্ছে না।
অমিয়বাবুর ক্ষোভ, ‘‘মশা গবেষণার যে কেন্দ্র রাজ্যে চিকিৎসা পরিকাঠামোয় অন্যতম দিকচিহ্ন ছিল, তারই এই হাল। সরকার কি এর দায় এড়াতে পারে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy