ধর্মতলার ফুটপাথ।
বৃষ্টির মেয়াদ এক ঘণ্টাও নয়! আর তাতেই ফের জল দাঁড়িয়ে গেল শহরের বেশ কিছু অংশে। দিন কয়েক আগেই এক বার বৃষ্টির জলে ‘ডুবেছিল’ কলকাতা। বুধবার বিকেলে খানিকক্ষণের প্রবল বৃষ্টিতে সেই দুর্ভোগের পুনরাবৃত্তি হল। উত্তর ও মধ্য কলকাতার সঙ্গে সঙ্গে বাদ গেল না সল্টলেকও। শুধু ভারী বৃষ্টি তেমন না হওয়ায় রেহাই পেয়েছে দক্ষিণ কলকাতা।
বুধবার বিকেলের তুমুল বৃষ্টিতে জলে ‘ডুবল’ উত্তর ও মধ্য কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকা। কোথাও জল জমল এক ফুট, কোথাও দেড় ফুট। জল জমল খোদ পুরসভার সদর দফতরের চারপাশেও! যা দেখে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘বৃষ্টি হলে জল তো জমবেই! নামতেও সময় লাগবে।’’
পরে তিনি দাবি করেন, বুধবার রাত ১২টার মধ্যে সর্বত্র জল নেমে যাবে। যদিও মাঝরাতের পরে অনেক জায়গায় জল জমেই ছিল।
দিন কয়েক আগের বৃষ্টিতে জল জমার সময়েও মেয়র দাবি করেছিলেন, কলকাতায় জল জমেনি। যদিও ভিন্ন অভিজ্ঞতা ছিল নগরবাসীর। এ দিন বিকেলে বৃষ্টির বহর দেখেই তাই নড়েচড়ে বসেছিলেন মেয়র। বৃষ্টি বাড়তেই সটান চলে গিয়েছিলেন নিকাশি দফতরের মেয়র পারিষদ তারক সিংহের ঘরে। সেখানে বসেই ঘন ঘন কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ রাখতে থাকেন মেয়র ও মেয়র-পারিষদ। কোথায় কত বৃষ্টি রেকর্ড হচ্ছে, পাম্প চালানো শুরু হল কি না, সে সবই দু’জনকে জানাতে থাকেন পুর-অফিসারেরা।
পুরসভার নথি বলছে, ভরসন্ধ্যায় কলুটোলা, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে হাঁটু-ডোবা জল। আমহার্স্ট স্ট্রিটেও জলের গভীরতা ১ ফুট ৩ ইঞ্চি। বুধবার অনেক রাত পর্যন্ত পাম্প চালিয়ে অনেক জায়গায় জল নামাতে পেরেছে পুরসভা। শুধু দক্ষিণ কলকাতায় তেমন ভাবে জল জমার খবর মেলেনি।
পুর হিসেবে উত্তর, পূর্ব ও মধ্য কলকাতায় বুধবার বিকেলে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত মানিকতলা ও ঠনঠনিয়া পাম্পিং স্টেশনে যথাক্রমে ১১১ ও ১০১ মিমি বৃষ্টি হয়েছে। ভারী বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে উল্টোডাঙা ও পামারবাজার পাম্পিং স্টেশনেও।
হাওয়া অফিস সূত্রে খবর, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের উপরে একটি নিম্নচাপ অক্ষরেখা সক্রিয় রয়েছে। তার জেরে সাগর থেকে জলীয় বাষ্প পরিমণ্ডলে ঢুকছে। তা-ই ঘনীভূত হয়ে বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি করছে। এমন একটি বজ্রগর্ভ মেঘপু়ঞ্জ থেকেই এ দিন ভারী বৃষ্টি হয়েছে। আজ, বৃহস্পতিবারেও বৃষ্টির পূর্বাভাস দিচ্ছেন আবহবিদেরা।
সেই বৃষ্টির জেরেই এ দিন কলকাতার একাংশ ফের জলমগ্ন। রাত পর্যন্ত যানজটে নাকাল হয়েছেন মানুষ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে গিয়ে হিমসিম খেয়েছে ট্রাফিক পুলিশও। ভরসন্ধ্যায় এক ট্রাফিককর্তাকে ফোনে ধরতেই বললেন, ‘‘দক্ষিণ কলকাতা বাদে শহরের বেশির ভাগ জায়গাতেই যান চলাচল জট পাকিয়ে গিয়েছে।’’
সন্ধ্যার পরে অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে গিয়ে নাজেহাল হয়েছেন অনেকে। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে বাসে বসেছিলেন বেলুড়ের এক বাসিন্দা। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘‘চোখের সামনে সিগন্যাল লাল থেকে সবুজ আর সবুজ থেকে লাল হল। কিন্তু কোনও গাড়ি নড়ল না!’’ দমদম থেকে সুকিয়া স্ট্রিটে বাপের বাড়িতে এসেছিলেন এক মহিলা। বিকেলে বেরোতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন বৃষ্টিতে। হোয়্যাটসঅ্যাপে বন্ধুদের মেসেজ পাঠালেন, ‘‘প্রচণ্ড বৃষ্টি। জল জমতে শুরু করেছে। বেরোতে পারব কি না, জানি না।’’ লালবাজারের খবর, কলেজ স্ট্রিট, ঠনঠনিয়া, স্ট্র্যান্ড রোড, সুকিয়া স্ট্রিটে হাঁটু-ডোবা জল। ধর্মতলার সিধো-কানহো ডহরেও হাঁটু-জল দেখে চমকে যান অনেকে।
অনেকেই ভেবেছিলেন, রাস্তায় জট এড়িয়ে ট্রেনে বাড়ি ফিরবেন। শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে দেখলেন পাঁচটি লাইন জলের তলায়। শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার কিছু জায়গাতেও লাইনে জল জমেছিল। রেল জানায়, বৃষ্টিতে এ দিন ব্যাহত হয়েছে ট্রেন চলাচল। গভীর রাত পর্যন্ত সে সমস্যা মেটেনি।
এ দিনের জল জমার কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গেই আরও একটি ‘বার্তা’ দিয়েছে মৌসম ভবন। সেখানকার আবহবিদেরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা উপকূলে আরও একটি ঘূর্ণাবর্ত জন্ম নেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেটি অক্ষরেখার দোসর হলে কলকাতার কপালে কী রয়েছে, সেটাই এখন প্রশ্ন।
থইথই সল্টলেকও
বুধবারের বৃষ্টিতে বেশ জল জমল সল্টলেক ও পাঁচ নম্বর সেক্টরে। একই অবস্থা সংযুক্ত এলাকাতেও।
বাসিন্দাদের অভিযোগ, বর্ষার আগে সল্টলেকের খাল সংস্কার, ড্রেনেজ পাম্পিং স্টেশনের সংস্কার, গালিপিট, কার্বচ্যানেল পরিষ্কার রাখার কাজ না হওয়ায় ভুগতে হচ্ছে।
বুধবার বিকেল থেকে মাত্র ৪৫ মিনিটের বৃষ্টিতে পাঁচ নম্বর সেক্টরের একাধিক এলাকায় হাঁটু পর্যন্ত জল দাঁড়িয়ে যায়। এলাকার প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা নবদিগন্ত শিল্পনগরী কর্তৃপক্ষ দ্রুত কর্মী নামিয়ে পাম্প চালান। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে রাত গড়িয়ে যায়। বাড়ি ফেরার পথে ভোগান্তি হয় আইটি কর্মীদের। তাঁদের অভিযোগ, বৃষ্টি হলেই পাঁচ নম্বর সেক্টর জলমগ্ন হয়। কেন জল নামাতে স্থায়ী কোনও পরিকল্পনা করছে না রাজ্য প্রশাসন?
যদিও নবদিগন্তের দাবি, পাম্প চালিয়ে জল দ্রুতই সরানো হয়েছে। তবে ইস্টার্ন ড্রেনেজ চ্যানেল টইটম্বুর হওয়ার কারণে জল টানতে পারেনি। উল্টো দিকে, ফের সল্টলেকের ৩ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন এলাকা জলমগ্ন হয়। দত্তাবাদ ও সংযুক্ত এলাকাতেও বহু জায়গা জলমগ্ন হয়েছে। বিকেলের এই বৃষ্টিতে সবচেয়ে খারাপ দশা সল্টলেকের অফিসপাড়ায়। ডিডি ব্লক থেকে শুরু করে করুণাময়ী মোড় পর্যন্ত এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এই কারণে যানজটও হয়ে যায়। কেষ্টপুর খালও জলে ভরে থাকায় সল্টলেক থেকে জল সরছে না বলে প্রশাসনের একাংশের দাবি।
বাসিন্দাদের আরও অভিযোগ, সল্টলেকে নিকাশির পরিকাঠামো ৫০ বছরের পুরনো। বারবার তা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও কাজ হয়নি। যার জেরেই এই অবস্থা। যদিও বিধাননগর পুর প্রশাসনের এক কর্তা জানান, খুব কম সময়ে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। যার জন্য বেশ কিছু এলাকায় জল দাঁড়িয়ে যায়। তবে এ দিন জল দ্রুত সরানো হয়েছে বলেই তাঁদের দাবি। যদিও পুরকর্মীদের একাংশের কথায়, দু’দিকের খাল সংস্কার না করলে জল সরবে না।
বাসিন্দাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুর-প্রশাসনের একাংশের দাবি, পরিকাঠামো সংস্কারের জন্য কাজ শুরু হয়েছে। তবে কাজ পুরোপুরি শেষ হতে কিছুটা সময় লাগবে।
ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য, শৌভিক দে ও স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy